logo

HOMOEOPATHY DOCTOR

📚 Home

অগ্রসর কর্মী মানয়োন্নয়ন গাইড

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য দরস, বই নোট, বিষয়ভিত্তিক আয়াত-হাদিস ও মাসয়ালা সংকলন

অনুশীলনী- 8: ফেব্রুয়ারী ৩য় সপ্তাহঃ
# দারস তৈরী - সূরা যিলযাল # বই নোট: তাফহিমুল কুরআনের ভূমিকা/ আল কুরআনের মর্ম কথা # দাওয়াত সংক্রান্ত আয়াত # দাওয়াত সংক্রান্ত হাদিস # বিভিন্ন নামাজ সংক্রান্ত মাসয়ালা

দারস তৈরী -সূরা যিলযাল

মোট আয়াতঃ ৮
إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَ
১. যখন প্রবল কম্পনে যমীন প্রকম্পিত করা হবে
وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا
২, আর যমীন তার ভার বের করে দেবে,
وَقَالَ الْإِنْسَانُ مَا لَهَا
৩. আর মানুষ বলবে, এর কী হল?
يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا
৪. সেদিন যমীন তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে,
بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا
৫. কারণ আপনার রব তাকে নির্দেশ দিয়েছেন,
یَوۡمَئِذٍ یَّصۡدُرُ النَّاسُ اَشۡتَاتًا ۬ۙ لِّیُرَوۡا اَعۡمَالَهُمۡ ؕ
৬. সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বের হবে, যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখান যায়,
فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ
وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
৭.তারপর যে অতি অল্প পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখে নেবে
৮. এবং যে অতি অল্প পরিমাণ খারাপ কাজ করবে সে তা দেখে নেবে

নামকরনঃ সুরার প্রথম আয়াতের زِلْزَالَهَ থেকে এর নামকরন করা হয়েছে। ‘যালযালাহু’ মানে হচ্ছে, প্রচণ্ডভাবে জোরে জোরে ঝাড়া দেয়া, ভূকম্পিত হওয়া।

নাযিলের সময়কালঃ মদীনায় অবতীর্ণ (মতভেদ)। এই সূরার মাক্কী ও মাদানী হওয়ার ব্যাপারে উলামাগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর কেউ বলেন, এটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সূরার ফযীলতে বেশ কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনটিও সহীহ নয়। এটি একটি মক্কী সূরা। এর বক্তব্য বিষয় ও বর্ণনাভংগী থেকে অনুভূত হবে, এটি মক্কায় প্রাথমিক যুগে এমন সময় নাযিল হয় যখন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতিতে ইসলামের বুনিয়াদি আকিদা ও বিশ্বাস মানুষের সামনে পেশ করা হচ্ছিল।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্যঃ এর বিষয়বস্তু মৃত্যুর পরবর্তী জীবন এবং সেখানে দুনিয়ায় করা সমস্ত কাজের হিসেব মানুষের সামনে এসে যাওয়া। সর্বপ্রথম তিনটি ছোট ছোট বাক্যে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর মানুষের দ্বিতীয় জীবনের সূত্রপাত কিভাবে হবে এবং মানুষের জন্য তা হবে কেমন বিস্ময়কর। তারপর দু’টি বাক্যে বলা হয়েছে, মানুষ এই পৃথিবীর বুকে অবস্থান করে নিশ্চিন্তে সব রকমের কাজ করে গেছে। সে কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি যে, এই নিষ্প্রাণ জিনিস কোনদিন তার কাজকর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। আল্লাহর হুকুমে সেদিন সে কথা বলতে থাকবে। প্রত্যেকটি লোকের ব্যাপারে সে বলবে, কোন সময় কোথায় সে কি কাজ করেছিল। তারপর বলা হয়েছে, সেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষের নিজেদের কবর থেকে বের হয়ে দলে দলে আসতে থাকবে। তাদের কর্মকাণ্ড তাদেরকে দেখানো হবে। এমন পূর্ণাংগ ও বিস্তারিতভাবে এই কর্মকাণ্ড পেশ করা হবে যে, সামান্য বালুকণা পরিমাণ নেকী বা পাপও সামনে এসে যাবে।

আয়াতের ব্যাখ্যাঃ

إِذَا زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَ

১. যখন প্রবল কম্পনে যমীন প্রকম্পিত করা হবে। ‘যালযালাহু’ মানে হচ্ছে, প্রচণ্ডভাবে জোরে জোরে ঝাড়া দেয়া, ভূকম্পিত হওয়া। অর্থাৎ, এর অর্থ হল ভূমিকম্পের কারণে সারা পৃথিবী কেঁপে উঠবে। আর সমস্ত বস্তু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। এই অবস্থা তখন হবে, যখন শিঙ্গায় প্রথমবার ফুৎকার করা হবে।

وَأَخْرَجَتِ الْأَرْضُ أَثْقَالَهَا

২. আর যমীন তার ভার বের করে দেবে। মাটির নিচে যত লোক দাফন আছে, তাদেরকে পৃথিবীর ভার বা বোঝা বলা হয়েছে। মাটি তাদেরকে কিয়ামতের দিন বের করে উপরে ফেলবে। অর্থাৎ, আল্লাহর হুকুমে সকলে জীবিত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে। আর এরূপ হবে শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুৎকারের পর।

وَقَالَ الْإِنْسَانُ مَا لَهَا

৩. আর মানুষ বলবে, এর কী হল? মানুষ অর্থ প্রত্যেকটি মানুষ হতে পারে। কারণ পুনরায় জীবন লাভ করে চেতনা ফিরে পাবার সাথে সাথেই প্রত্যেক ব্যক্তির প্রথম প্রতিক্রিয়া এটিই হবে যে, এসব কি হচ্ছে? আবার মানুষ অর্থ আখেরাত অস্বীকারকারী মানুষও হতে পারে। কারণ যে বিষয়কে অসম্ভব মনে করতো তা তার সামনে ঘটে যেতে থাকবে এবং সে এসব দেখে অবাক ও পেরেশান হবে। তবে ঈমানদারদের মনে এ ধরনের বিস্ময় থাকবে না।

يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا

৪. সেদিন যমীন তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে,

(১) যমীন কি জানিয়ে দেবে এ নিয়ে তাফসীরবিদদের মধ্যে কয়েকটি মত রয়েছে। সম্ভবত সব কয়টি মতই এখানে উদ্দেশ্য হতে পারে।

এক. ইয়াহইয়া ইবনে সালাম বলেন, এর অর্থ, যমীন তার থেকে যা যা বের করে দিল (সম্পদরাজি) তা জানিয়ে দিবে। এর সমর্থনে একটি হাদীসে এসেছে, “কোন মানুষের জীবন যদি কোন সুনির্দিষ্ট স্থানে অবসান হওয়ার কথা থাকে তখন আল্লাহ তার জন্য সেখানে যাওয়ার একটি প্রয়োজন তৈরী করে দেন। তারপর যখন সে স্থানে পৌঁছে তখন তাকে মৃত্যু দেয়া হয়। তারপর যমীন কিয়ামতের দিন বলবে, হে রব! এটা তুমি আমার কাছে আমানত রেখেছিলে।” [ইবনে মাজাহ: ৪২৬৩]

দুই. ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এ আয়াতের অর্থ, আগের আয়াতে যে বলা হয়েছে মানুষ প্রশ্ন করবে, যমীনের কি হল? এর জওয়াব যমীনই দিবে যে, কিয়ামত অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে।

তিন. আবু হুৱায়ারা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এর অর্থ, যমীন তার মধ্যে কৃত ভাল-মন্দ যাবতীয় কর্মকাণ্ডের হিসাব দাখিল করবে। যমীনের ওপর যা কিছু ঘটে গেছে তার সবকিছু সে কিয়ামতের দিন বলে দেবে। [কুরতুবী]

بِأَنَّ رَبَّكَ أَوْحَى لَهَا

৫. কারণ আপনার রব তাকে নির্দেশ দিয়েছেন, কারণ তোমার প্রতিপালক তাকে আদেশ করবেন।

অর্থাৎ, মাটিকে কথা বলার শক্তি আল্লাহই সেদিন দান করবেন। অতএব এটা কোন আশ্চর্যজনক কথা নয়। যেমন সেদিন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহ বাকশক্তি দান করবেন, ঠিক মাটিও আল্লাহর হুকুমে কথা বলবে।

یَوۡمَئِذٍ یَّصۡدُرُ النَّاسُ اَشۡتَاتًا ۬ۙ لِّیُرَوۡا اَعۡمَالَهُمۡ

৬. সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বের হবে, যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখান যায়।

এর অর্থ, মানুষ সেদিন হাশরের মাঠ থেকে তাদের আমল অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাবে; তাদের কেউ জান্নাতে যাবে, কেউ যাবে জাহান্নামে।

এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, বিগত হাজার হাজার বছরে সমস্ত মানুষ যে যেখানে মরেছিল সেখান থেকে অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে থেকে দলে দলে চলে আসতে থাকবে।

অর্থাৎ তাদের আমল তাদেরকে দেখানো হবে। প্রত্যেকে দুনিয়ায় কি কাজ করে এসেছে তা তাকে বলা হবে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কাফের-মুমিন, সৎকর্মশীল-ফাসেক, আল্লাহর হুকুমের অনুগত-নাফরমান সবাইকে অবশ্যই তাদের আমলনামা দেয়া হবে।

يَصْدُر শব্দের অর্থ হল, বের হবে, ফিরে যাবে। অর্থাৎ, কবর থেকে বের হয়ে হিসাবের ময়দানের দিকে অথবা হিসাব শেষে জান্নাত অথবা জাহান্নামের দিকে ফিরে যাবে। أشتَاتا শব্দের অর্থ হল, ভিন্ন ভিন্ন; অর্থাৎ, দলে দলে। কিছু লোক ভয়শূন্য হবে, কিছু ভয়ে ভীত হবে। কিছু লোকের রঙ গৌরবর্ণের হবে; যেমন জান্নাতীদের হবে। আবার কিছু লোকের রঙ কাল বর্ণের হবে; যা তাদের জাহান্নামী হওয়ার নিদর্শন হবে।

সূরা আল-হাক্কাহ (১৮-৩৭)

یَوۡمَئِذٍ تُعۡرَضُوۡنَ لَا تَخۡفٰی مِنۡكُمۡ خَافِیَۃٌ ﴿۱۸﴾
সেদিনটিতে তোমাদেরকে পেশ করা হবে। তোমাদের কোন গোপনীয় বিষয়ই আর সেদিন গোপন থাকবে না।

فَاَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ كِتٰبَهٗ بِیَمِیۡنِهٖ ۙ فَیَقُوۡلُ هَآؤُمُ اقۡرَءُوۡا كِتٰبِیَهۡ ﴿ۚ۱۹﴾
সে সময় যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, সে বলবে: নাও, আমার আমলনামা পড়ে দেখো।

اِنِّیۡ ظَنَنۡتُ اَنِّیۡ مُلٰقٍ حِسَابِیَهۡ ﴿ۚ۲۰﴾
আমি জানতাম, আমাকে হিসেবের সম্মুখীন হতে হবে।

فَهُوَ فِیۡ عِیۡشَۃٍ رَّاضِیَۃٍ ﴿ۙ۲۱﴾
তাই সে মনের মত আরাম আয়েশের মধ্যে থাকবে।

فِیۡ جَنَّۃٍ عَالِیَۃٍ ﴿ۙ۲۲﴾
উন্নত মর্যাদার জান্নাতে।

قُطُوۡفُهَا دَانِیَۃٌ ﴿۲۳﴾
যার ফলের গুচ্ছসমূহ নাগালের সীমায় অবনমিত হয়ে থাকবে।

كُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا هَنِیۡٓـئًۢا بِمَاۤ اَسۡلَفۡتُمۡ فِی الۡاَیَّامِ الۡخَالِیَۃِ ﴿۲৪﴾
(এসব লোকদের কে বলা হবে:) অতীত দিনগুলোতে তোমরা যা করে এসেছো তার বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তির সাথে খাও এবং পান করো।

وَ اَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ كِتٰبَهٗ بِشِمَالِهٖ ۬ۙ فَیَقُوۡلُ یٰلَیۡتَنِیۡ لَمۡ اُوۡتَ كِتٰبِیَهۡ ﴿ۚ۲۵﴾
আর যার আমলনামা তার বাঁ হাতে দেয়া হবে সে বলবে: হায়! আমার আমলনামা যদি আমাকে আদৌ দেয়া না হতো।

وَ لَمۡ اَدۡرِ مَا حِسَابِیَهۡ ﴿ۚ۲۶﴾
এবং আমার হিসেব যদি আমি আদৌ না জানতাম তাহলে কতই না ভাল হত।

یٰلَیۡتَهَا كَانَتِ الۡقَاضِیَۃَ ﴿ۚ۲۷﴾
হায়! আমার সেই মৃত্যুই (যা দুনিয়াতে এসেছিলো) যদি চূড়ান্ত হতো।

مَاۤ اَغۡنٰی عَنِّیۡ مَالِیَهۡ ﴿ۚ۲۸﴾
আজ আমার অর্থ-সম্পদ কোন কাজে আসলো না।

هَلَكَ عَنِّیۡ سُلۡطٰنِیَهۡ ﴿ۚ۲۹﴾
আমার সব ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিনাশ প্রাপ্ত হয়েছে।

خُذُوۡهُ فَغُلُّوۡهُ ﴿ۙ۳۰﴾
(আদেশ দেয়া হবে) পাকড়াও করো ওকে আর ওর গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও।

ثُمَّ الۡجَحِیۡمَ صَلُّوۡهُ ﴿ۙ۳۱﴾
তারপর জাহান্নামে নিক্ষেপ করো।

ثُمَّ فِیۡ سِلۡسِلَۃٍ ذَرۡعُهَا سَبۡعُوۡنَ ذِرَاعًا فَاسۡلُكُوۡهُ ﴿ؕ۳۲﴾
এবং সত্তর হাত লম্বা শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলো।

اِنَّهٗ كَانَ لَا یُؤۡمِنُ بِاللّٰهِ الۡعَظِیۡمِ ﴿ۙ۳۳﴾
সে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করতো না।

وَ لَا یَحُضُّ عَلٰی طَعَامِ الۡمِسۡکِیۡنِ ﴿ؕ۳۴﴾
এবং দুস্থ মানুষের খাদ্য দিতে উৎসাহিত করতো না।

فَلَیۡسَ لَهُ الۡیَوۡمَ هٰهُنَا حَمِیۡمٌ ﴿ۙ۳۵﴾
তাই আজকে এখানে তার সমব্যথী কোন বন্ধু নেই।

وَّ لَا طَعَامٌ اِلَّا مِنۡ غِسۡلِیۡنٍ ﴿ۙ۳۶﴾
আর কোন খাদ্যও নেই ক্ষত নিঃসৃত পূঁজ-রক্ত ছাড়া।

لَّا یَاۡكُلُهٗۤ اِلَّا الۡخَاطِـُٔوۡنَ ﴿۳۷﴾
যা পাপীরা ছাড়া আর কেউ খাবে না।

---

সূরা আল-ইনশিকাক (৬-১৫)

یٰۤاَیُّهَا الۡاِنۡسَانُ اِنَّكَ كَادِحٌ اِلٰی رَبِّكَ كَدۡحًا فَمُلٰقِیۡهِ ۚ﴿۶﴾
হে মানুষ! তুমি কঠোর পরিশ্রম করতে করতে তোমার রবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো, পরে তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে।

فَاَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ كِتٰبَهٗ بِیَمِیۡنِهٖ ۙ﴿۷﴾
তারপর যার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হয়েছে,

فَسَوۡفَ یُحَاسَبُ حِسَابًا یَّسِیۡرًا ۙ﴿۸﴾
তার কাছ থেকে হালকা হিসেব নেয়া হবে।

وَّ یَنۡقَلِبُ اِلٰۤی اَهۡلِهٖ مَسۡرُوۡرًا ؕ﴿۹﴾
এবং সে হাসিমুখে নিজের লোকজনের কাছে ফিরে যাবে।

وَ اَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ كِتٰبَهٗ وَرَآءَ ظَهۡرِهٖ ﴿ۙ۱۰﴾
আর যার আমলনামা তার পিছন দিক দেয়া হবে।

فَسَوۡفَ یَدۡعُوۡا ثُبُوۡرًا ﴿ۙ۱۱﴾
সে মৃত্যুকে ডাকবে।

وَّ یَصۡلٰی سَعِیۡرًا ﴿ؕ۱۲﴾
এবং জ্বলন্ত আগুনে গিয়ে পড়বে।

اِنَّهٗ كَانَ فِیۡۤ اَهۡلِهٖ مَسۡرُوۡرًا ﴿ؕ۱۳﴾
সে নিজের পরিবারের লোকদের মধ্যে ডুবে ছিল।

اِنَّهٗ ظَنَّ اَنۡ لَّنۡ یَّحُوۡرَ ﴿ۚۛ۱۴﴾
সে মনে করেছিল, তাকে কখনো ফিরতে হবে না।

بَلٰۤی ۚۛ اِنَّ رَبَّهٗ كَانَ بِهٖ بَصِیۡرًا ﴿ؕ۱৫﴾
না ফিরে সে পারতো কেমন করে? তার রব তার কার্যকলাপ দেখছিলেন।

অপরাধীদেরকে ঘিরে আনা হবে

কিয়ামতের দিন শরীর প্রকম্পিত হওয়ার মতো অবস্থা দেখে মানুষ ভয়ে এমনই দিশেহারা হয়ে পড়বে যে, তারা কিছুতেই স্মরণ করতে পারবে না পৃথিবীতে জীবিত থাকা কালে তারা কত দিন জীবিত ছিল। পরকালের সূচনা এবং তার দীর্ঘতা দেখে পৃথিবীর শত বছরের হায়াতকে তারা মনে করবে বোধ হয় এই ঘন্টাখানেক পৃথিবীতে ছিলাম। ইসলামী বিধান যারা মানেনি তারা সেদিন পৃথিবীতে কত হায়াত পেয়েছিল তা ভুলে যাবে। এ ভুলে যাওয়া কোন স্বাভাবিকভাবে ভুলে যাওয়া নয় বরং ভয়ে আতঙ্কে ভুলে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন-

یَّوۡمَ یُنۡفَخُ فِی الصُّوۡرِ وَ نَحۡشُرُ الۡمُجۡرِمِیۡنَ یَوۡمَئِذٍ زُرۡقًا ﴿۱۰۲﴾ۚۖ
অপরাধীদেরকে এমনভাবে ঘিরে আনবো যে তাদের চক্ষু আতংকে বিষ্ফোরিত হয়ে যাবে। তারা পরস্পর ফিসফিস করে বলাবলি করবে, আমরা পৃথিবীতে বড় জোর দশদিন মাত্র সময় কাটিয়েছি। (সূরা ত্ব-হা-১০২)

মহান আল্লাহ সেদিন মানুষকে প্রশ্ন করবেন-

قٰلَ كَمۡ لَبِثۡتُمۡ فِی الۡاَرۡضِ عَدَدَ سِنِیۡنَ ﴿۱۱۲﴾
তোমরা পৃথিবীতে কতদিন ছিলে?

قَالُوۡا لَبِثۡنَا یَوۡمًا اَوۡ بَعۡضَ یَوۡمٍ فَسۡـَٔلِ الۡعَآدِّیۡنَ ﴿۱۱۳﴾
উত্তরে তারা বলবে একদিন বা তার চেয়ে কম সময় আমরা পৃথিবীতে ছিলাম। (সূরা মুমিনুন-১১২-১১৩)

আল্লাহর কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে-

وَ یَوۡمَ تَقُوۡمُ السَّاعَۃُ یُقۡسِمُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ ۬ۙ مَا لَبِثُوۡا غَیۡرَ سَاعَۃٍ ؕ كَذٰلِكَ كَانُوۡا یُؤۡفَكُوۡنَ ﴿۵۵﴾
যখন সে সময়টি এসে পড়বে, তখন অপরাধীগণ শপথ করে বলবে যে পৃথিবীতে আমরা এক ঘন্টার বেশি ছিলাম না। (সূরা রূম-৫৫)

﴿فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ﴾

৭) তারপর যে অতি অল্প পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখে নেবে

﴿وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ﴾

৮) এবং যে অতি অল্প পরিমাণ খারাপ কাজ করবে সে তা দেখে নেবে৷

ذَرَّةٍ অর্থ বিন্দু, সরিষাদানা, ছোট্ট পিপীলিকা। এর দ্বারা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছোট্ট বস্ত্তর উপমা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পাপ বা পূণ্য যত ছোটই হৌক না কেন ক্বিয়ামতে বিচারের দিন তা দেখা হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ ... (নিসা ৪/৪০)।

فَاَمَّا مَنۡ ثَقُلَتۡ مَوَازِیۡنُهٗ ۙ﴿۶ فَهُوَ فِیۡ عِیۡشَۃٍ رَّاضِیَۃٍ ؕ﴿۷ وَاَمَّا مَنۡ خَفَّتۡ مَوَازِیۡنُهٗ ۙ﴿۸ فَاُمُّهٗ هَاوِیَۃٌ ؕ﴿۹

সেদিন সব আমল ওযন করা হবে। যার ওযন ভারী হবে, সে জান্নাতী হবে। আর যার ওযন হালকা হবে, সে জাহান্নামী হবে (ক্বারে‘আহ ১০১/৬-৯)।

প্রত্যেকটি সামান্যতম সৎকাজ বা অসৎকাজের হিসাব অবশ্যই হবে। তাই কোন ছোট সৎকাজকে ছোট মনে করে ত্যাগ করা উচিত নয় এবং ছোট গোনাহকেও অবহেলা করা উচিত নয়।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

“জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো-তা এক টুকরা খেজুর দান করার বা একটি ভালো কথা বলার বিনিময়েই হোক না কেন” [বুখারী: ৬৫৪০]

“কোন সৎকাজকেও সামান্য মনে করো না, যদিও তা পানিচ্ছু ব্যক্তিকে পানি দেওয়া বা ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা হয়” [আহমাদ, বুখারী, মুসলিম]

“হে মুসলিম মেয়েরা! কোন প্রতিবেশী সামান্য উপহারকেও তুচ্ছ মনে করবে না” [বুখারী: ৬০১৭]

“ছোট গোনাহ থেকে দূরে থাকো। আল্লাহর দরবারে সেগুলোরও হিসাব হবে।” [ইবনে মাজাহ: ৪২৪৩]

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস: আয়াত ﴿فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ...﴾-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘অনন্য ও সারগর্ভ আয়াত’ বলেছেন।

কাফিরদের সৎকর্ম

কাফিররা আখেরাতে তাদের সৎকর্মের কোন প্রতিদান পাবে না। দুনিয়াতেই তারা তার প্রতিদান পেয়ে যাবে—যেমন ধন-সম্পদ, সন্তানাদি ও সুখ-সমৃদ্ধি। ক্বিয়ামতের দিন তাদের আমল ধূলিকণায় পরিণত করা হবে। (ফুরক্বান ২৫/২৩)

কারণ কুফরী তাদের সব আমল বিনষ্ট করে দেবে। তারা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। তবে তাদের শাস্তির তারতম্য হতে পারে। যেমন আবু ত্বালিবের শাস্তি হালকা করা হয়েছিল।

সংগৃহিতঃ
তাফসীরে যাকারিয়া, আহসানুল বয়ান ও তাফহীমুল কুর’আন থেকে নেয়া।

Top


বই নোট : তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা/ কুরআনের মর্ম কথা

সাইয়েদ আবুল আলা মাওদুদী (রহঃ)
নোটপ্রস্তুতকারী : তাজুল ইসলাম তাইমী’

১ম পয়েন্ট । তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা

প্রথমেই পরিষ্কার বার্তা :

এটি কুরআনের ভূমিকা নয়—তাফসিরগ্রন্থ তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা৷

১। তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকা: কুরআন পাঠকের সংকট @@ ২। সংকট উত্তরণের উপায় @@ ৩। কুরআনের মুল আলোচ্য@@ ৪। ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্ব @@ ৫। ইসলামী দাওয়াতের দ্বিতীয় অধ্যায় @@ ৬। ইসলামী দাওয়াতের তৃতীয় অধ্যায় @@ ৭। কুরআনের বণর্নাভংগী @@ ৮। এহেন বিন্যাসের কারণ @@ ৯। কুরআন কিভাবে সংকলিত হলো @@ ১০। কুরআন অধ্যায়নের পদ্ধতি @@ ১১। কুরআনের প্রাণসত্তা অনুধাবন @@ ১২। কুরআনী দাওয়াতের বিশ্বজনীনতা @@ ১৩। পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান @@ ১৪। বৈধ মতপার্থক্য @@

লেখার মূল লক্ষ্য দু’টি:

১. কুরআন বুঝার প্রাথমিক খোরাক :
কুরআন বুঝতে হলে কিছু প্রাথমিক সত্য আগে জানা দরকার৷ তা না হলে পাঠের মাঝপথে মনে আসবে সংশয়, আর থেমে যাবে হৃদয় দিয়ে অনুধাবনের পথ৷ বহু মানুষ বছরের পর বছর কেবল বাইরের কথা পড়ে যায়, ভেতরের আলোয় পৌঁছায় না৷

২. জিজ্ঞাসু মনের প্রথম আলাপন:
যে প্রশ্নগুলো কুরআন পড়ার শুরুতেই মনে জাগে, লেখক তাদের আগে থেকেই সামনে এনে জবাব দিয়েছেন৷ এসব প্রশ্ন তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ৷

কুরআন পাঠকের সংকট :
“যে দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রস্তুতি নিয়ে সাধারণ বই পড়া হয়, সেই মানসিকতা নিয়ে কুরআনের দরজায় এলে—কুরআন পাঠ নয়, বরং আত্মিক বিভ্রান্তিই বেশি হয়।”

এক নজরে কুরআন পাঠকের সংকটগুলো:

• পাঠক কুরআনকে সাধারণ বইয়ের মতো অধ্যায়ভিত্তিক ও ধারাবাহিক মনে করে পড়তে যান৷
• কিন্তু কুরআনের রচনাশৈলী, ভাষা ও উপস্থাপন একেবারে ভিন্ন হওয়ায় তারা বিভ্রান্ত হন৷
• কুরআনের মূল উদ্দেশ্য, কেন্দ্রীয় বার্তা ও প্রসঙ্গ না জানায় তারা তা ধরতে পারেন না৷
• ফলে তারা খণ্ড খণ্ড তত্ত্ব পেলেও কুরআনের সামগ্রিক দিক ও প্রাণসত্তা থেকে বঞ্চিত হন৷
• এই বিভ্রান্তি থেকেই অনেকের মনে সন্দেহ, বিকৃত ব্যাখ্যা ও ভুল সিদ্ধান্ত জন্ম নেয়৷
• মূল সংকট কুরআনের নয়, বরং পাঠকের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রস্তুতির অভাবে৷

বিস্তারিত :

১. সাধারণ বই-পাঠের মানসিকতা বনাম বাস্তবতা :
পাঠক কুরআনকেও সাধারণ পাঠ্যবইয়ের মতো অধ্যায়-অনুচ্ছেদ ভিত্তিক পাবে বলে ধরে নেয়৷ ভাবেন, ধারাবাহিকভাবে জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো সাজানো থাকবে—যেমন আইন, নীতি, ইতিহাস ইত্যাদি।
বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন : কুরআনে বিষয়বস্তু একাধারে আকীদা, শরীয়াহ, ইতিহাস, উপদেশ, ভয়, সুসংবাদ, যুক্তি—সব একত্র৷ এক প্রসঙ্গের মাঝে অন্য প্রসঙ্গ ঢুকে পড়ে; বর্ণনা ও শব্দবিন্যাসেও আসে বৈচিত্র্য৷

২. পাঠকের হতাশা ও বিভ্রান্তি:
সুবিন্যস্ত সূচিপত্র না পেয়ে পাঠক ভাবেন—এটি অগোছালো, খণ্ডিত বক্তব্যের সমষ্টি৷ সন্দেহবাদীরা এখানেই কুরআনের বিরুদ্ধে আপত্তির ভিত্তি তৈরি করে৷

৩. ব্যাতিক্রম রচনাশৈলী :
কুরআনের ভাষা, বিশ্লেষণপদ্ধতি, শব্দের গভীরতা, প্রেক্ষাপট ইত্যাদি সাধারণ পাঠ্যশাস্ত্র থেকে আলাদা৷ দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতির কারণে পাঠক আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থ ধরতে ব্যর্থ হয়৷

৪. ফলাফল:
কেউ কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন নসিহত ও উপদেশ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে৷ কেউবা ভুল পটভূমির কারণে অর্থবিকৃতি ও চিন্তার বিচ্যুতিতে পড়ে৷

৫. মূল সংকট:
কুরআন বোঝার আগে প্রয়োজন যথাযথ মানসিক প্রস্তুতি, দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষা ও বর্ণনা পদ্ধতির বোধ৷ এগুলো ছাড়া কুরআনের হৃদয় ছুঁয়ে দেখা সম্ভব নয়৷

২য় পয়েন্ট: সংকট উত্তরণের উপায় :

৪টি প্রশ্ন আগে বুঝতে হবে :
১. সংকট কী? — কুরআন পাঠকের সংকট হচ্ছে কুরআন বুঝতে গিয়ে সংশয় ও সন্দেহের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া৷
২. সংকট কেন এবং কোথা থেকে তৈরি হয়েছে? — মৌলিক ধারণার অভাবে৷
৩. সংকট কিসের উপর ভিত্তি করে? — কুরআনের পরিচয় ও মুহাম্মদ (সা.) এর দাওয়াত সম্পর্কে ভুল দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে৷
৪. সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কেমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন? — নিজস্ব চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে কুরবানী দিয়ে কুরআন ও রাসূলের (সা.) দাওয়াত অনুযায়ী দেখা৷

কুরআন সম্পর্কে মৌলিক ধারণা :
কুরআন কোনো প্রচলিত গ্রন্থ নয়; এটি এক অভিনব, স্বতন্ত্র ও সর্বযুগোপযোগী কিতাব। প্রচলিত বইয়ের কাঠামো ও মানদণ্ডে কুরআনকে বিচার করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়৷

কুরআন অনুধানের পূর্বশর্ত :
কুরআনের প্রকৃত পরিচয় ও তার উপস্থাপক রাসূল (সা.)-এর দাওয়াতকে গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে৷ বিশ্বাস না থাকলেও কুরআনের বক্তব্য বোঝার জন্য এর মূল দৃষ্টিভঙ্গিকে মেনে নিতে হয়৷

সূত্রসমূহ :

১ম সূত্র : আল্লাহর পরিচয়, মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য
২য় সূত্র : আল্লাহর ঘোষণা ; মানুষের দায়িত্ব, কর্মনীতি ও পরিণতি
৩য় সূত্র : অবাধ্যতার ইতিহাস
৪র্থ সূত্র : আল্লাহর পক্ষ থেকে হিদায়াত দেওয়ার পদ্ধতি
৫ম সূত্র : নবীগণের মিশন ও ভূমিকা
৬ষ্ঠ সূত্র : মুহাম্মাদ (সা.) ও চূড়ান্ত হেদায়াত

৩য় পয়েন্ট। আল কুরআনের আলোচ্য বিষয়

কুরআনের মূল বিষয়বস্তু :
মানুষের কল্যাণ কিসে—এই প্রশ্নের যথার্থ ও জাজ্জ্বল্যমান সত্যভিত্তিক উত্তর৷

কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় :
মানুষ যে মতবাদ ও কর্মনীতি গ্রহণ করেছে তা ভুল; সত্য হলো আল্লাহর দেওয়া দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি৷

চূড়ান্ত লক্ষ্য :
• মানুষকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি গ্রহণে আহ্বান৷
• আল্লাহর হেদায়াত স্পষ্টভাবে তুলে ধরা৷

মানব সমাজের সমস্যা :
অনুমাননির্ভরতা, প্রাকৃতিকতা ও শয়তানী প্রবৃত্তির কারণে মানুষ সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে৷ সত্য বিকৃতির কাজ মানুষ নিজেরাই করে এসেছে৷

তিনটি মূল বিষয় :
১. বিষয়বস্তু: মানব কল্যাণের সত্য অনুসন্ধান৷
২. আলোচ্য বিষয়: সত্য-মিথ্যার বিভ্রান্তি দূরীকরণ৷
৩. লক্ষ্য ও বক্তব্য: সত্য পথে আহ্বান৷

কুরআনের আলোচনার বিষয়সমূহ :
• আকাশ-পৃথিবীর গঠন
• মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া
• পূর্ববর্তী জাতির ইতিহাস
• জাতির আকীদা, নৈতিকতা, কর্মের সমালোচনা
• অতিপ্রাকৃত বিষয়াবলীর ব্যাখ্যা

বিষয়ভিত্তিক আলোচনা

উদ্দেশ্য:

  • কোনো নির্দিষ্ট বিদ্যার শিক্ষা নয়
  • সত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় মাত্রায় আলোচনা

আলোচনার বৈশিষ্ট্য:

  • সব আলোচনা কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ও দাওয়াতের দিকে আবর্তিত
  • অপ্রয়োজনীয় বিশদ ব্যাখ্যা পরিহার
  • গভীর ঐক্য ও সংগতি বজায় রেখে বিষয়বস্তুর উপস্থাপন

কুরআন নাযিলের পদ্ধতি

  1. ধাপে ধাপে নাযিল: কুরআন একসাথে নাযিল হয়নি, বরং ২৩ বছরে ধাপে ধাপে পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী নাযিল হয়।
  2. প্রচলিত গ্রন্থের মতো নয়: এতে ধারাবাহিক রচনা ও বিষয়বিন্যাস নেই; এটি এক অভিনব গ্রন্থ।
  3. প্রথম দিকের বিষয়বস্তু:
    • নবীকে প্রস্তুত করা: দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি শেখানো।
    • সত্য পরিচিতি ও ভুল ধারণা খণ্ডন।
    • সঠিক জীবনের দাওয়াত: নৈতিকতা ও কল্যাণের পথ দেখানো।

দাওয়াতের শুরু: মক্কা ও নিজ জাতি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে প্রসারিত করা হয়।

৪র্থ পয়েন্ট। ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্ব (মক্কী দাওয়াতের প্রথম ৪-৫ বছর):

  • দাওয়াতের শুরুতে সংক্ষিপ্ত, প্রাঞ্জল ও সাহিত্যসমৃদ্ধ আয়াত নাযিল হয় যা সহজেই মানুষের মনে গেঁথে যেত।
  • ভাষা ছিল মিষ্টি, প্রভাবশালী ও আরবদের রুচি অনুযায়ী।
  • স্থানীয় ইতিহাস, নিদর্শন ও বাস্তবতা দিয়ে সত্যের যুক্তি উপস্থাপন করা হতো।
  • প্রতিক্রিয়া তিন রকম:
    1. কিছু মানুষ ইসলাম কবুল করে উম্মাহ গঠন শুরু করেন।
    2. অনেকেই বিরোধিতায় নেমে পড়ে।
    3. দাওয়াত কুরাইশের সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হতে থাকে।

৫ম পয়েন্ট। দাওয়াতের দ্বিতীয় অধ্যায় (প্রায় ৯ বছর)

দ্বিতীয় অধ্যায় (প্রায় ৯ বছর):

  • ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে তীব্র সংঘাত শুরু হয়।
  • বিরোধীরা অপপ্রচার, নির্যাতন, বয়কট, হিজরতের বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।
  • এরপরও ইসলামী দাওয়াত ধীরে ধীরে বিস্তৃত হতে থাকে; প্রায় সব বংশে কেউ না কেউ ইসলাম গ্রহণ করে।
  • আল্লাহর পক্ষ থেকে সান্ত্বনা, তাকওয়া, ধৈর্য, দাওয়াতের পদ্ধতি ও ঈমানদারদের প্রশিক্ষণমূলক আয়াত নাযিল হতে থাকে।
  • শিরক ও জাহেলিয়াতকে যুক্তির মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা হয়, তাদের সন্দেহ দূর করা হয়।

৬ষ্ঠ পয়েন্ট। দাওয়াতের তৃতীয় অধ্যায়

তৃতীয় অধ্যায় (মদীনী পর্ব – ১০ বছর):

  • হিজরতের মাধ্যমে মুসলিমদের জন্য মদিনায় একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়।
  • ইসলাম রাষ্ট্রীয় রূপ পায়; যুদ্ধ, মুনাফিক ও আহলে কিতাবদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়।
  • কুরআনের বাণী এখন রাজকীয় ফরমান, রাষ্ট্রনীতি, সামাজিক বিধান ও শত্রুদের মোকাবেলার নির্দেশনায় পূর্ণ।
  • মুসলমানদের আত্মগঠনে, সমাজ গঠনে ও জিহাদের প্রেরণায় নাযিল হয় আয়াতসমূহ।
  • ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ ও বৈশ্বিক দাওয়াতের ভিত্তি গড়ে তোলা হয়।

৭ম পয়েন্ট। কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি

  • দাওয়াতি সূচনা: কুরআনের প্রথম নাজিল শুরু হয় একটি দাওয়াতি আহ্বান নিয়ে।
  • ২৩ বছরের বাস্তবতা: দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায়ে ও পরিস্থিতিতে প্রয়োজন অনুযায়ী কুরআনের বিভিন্ন অংশ নাযিল হয়।
  • রচনাশৈলী আলাদা: কুরআনের বর্ণনা ডক্টরেট থিসিস বা গবেষণাপত্রের মতো নয়।
  • বক্তৃতাভঙ্গি: কুরআনের সূরা ও আয়াতগুলো বক্তৃতা ও ভাষণের মতো, যা মানুষের হৃদয়, বিবেক ও আবেগকে লক্ষ্য করে।
  • আহ্বানকারীর ভাষা: এটি কোনো অধ্যাপকের নয়, বরং একজন আহ্বানকারীর আবেগপূর্ণ ভাষণ।
  • বহুমুখী কাজ: রাসূল ﷺ-কে চিন্তা বদল, আবেগ জাগানো, বিরোধিতা ভাঙা, সাথীদের প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণা দেওয়া, শত্রুদের মোকাবিলা করা—সব একসাথে করতে হতো।
  • ভাষার বৈচিত্র্য: কুরআনের ভাষা এই বাস্তব দাওয়াতের উপযোগীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে; কোনো নির্দিষ্ট একক ভঙ্গি নয়।
  • পুনরাবৃত্তির কারণ: এক পর্যায়ে থাকা অবস্থায় একই বিষয়ের বারবার আলোচনা দরকার হয়; কিন্তু তা ভিন্ন ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়।
  • ভিন্ন ভিন্ন ভাষার ব্যবহার: পুনরাবৃত্তিকে বিরক্তিকর না করে নতুন রূপ, শব্দ ও শৈলীতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
  • মূলনীতি কখনো আড়ালে যায় না: তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাত, তাকওয়া, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলো পুরো কুরআনে বারবার এসেছে।
  • কারণ: এই মৌলিক ধারণাগুলো দুর্বল হলে ইসলামী আন্দোলনের প্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে যেত।

৮ম পয়েন্ট। এহেন বিন্যাসের কারণ

  • নাযিলের ক্রম রাখা হয়নি কেন? কুরআন নাযিলের যে ধারায় এসেছে, নবী ﷺ তা বিন্যাসে অক্ষুণ্ন রাখেননি; কারণ দাওয়াত পরিপূর্ণ হওয়ার পর তার উপযোগিতা পরিবর্তিত হয়েছে।
  • দাওয়াতের পর্যায়ভিত্তিক নাযিল: কুরআন ইসলামী দাওয়াতের অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন পর্যায়ে নাযিল হয়েছে।
  • পরিপূর্ণ দাওয়াতের পর নতুন প্রয়োজন: ইসলাম প্রচারের শুরুতে অপরিচিতদের জন্য শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় ছিল; পরে, ঈমানদারদের দায়িত্ব, শাসন, সমাজ ও ইতিহাসের শিক্ষা প্রয়োজন হয়।
  • নতুন বিন্যাসের প্রয়োজন: পরিণত উম্মাহর জন্য প্রয়োজন হয় একটি সম্পূর্ণ, সংগঠিত ও লক্ষ্যভিত্তিক কিতাব।
  • কুরআনের প্রকৃতি: একই বিষয়ের আলোচনা মক্কী ও মাদানী সূরায় ছড়িয়ে থাকলেও এতে ইসলামের সামগ্রিক চিত্র পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়।
  • বিভিন্ন পর্যায়ের মিশ্র বর্ণনা: মক্কী যুগের আলোচনা মাদানী সূরায়, আর মাদানী নির্দেশনা মক্কী সূরার মধ্যে আসতে পারে—এই বৈচিত্র্যেই ইসলামের পূর্ণতা ফুটে ওঠে।
  • নাযিলের ক্রমে বিন্যাস করলে সমস্যা: তখন কুরআনের সাথে প্রতিটি আয়াতের নাযিল-পরিস্থিতির ইতিহাস জুড়ে দিতে হতো, যা আল্লাহর উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হতো।

আল্লাহর উদ্দেশ্য:

  • কুরআন যেন সব শ্রেণির মানুষ—শিশু, নারী, বৃদ্ধ, সাধারণ, পণ্ডিত—সহজে বুঝতে ও পাঠ করতে পারে।
  • নির্ভেজাল কিতাব: আল্লাহর বাণীকে অন্য কোনো ইতিহাস বা ব্যাখ্যার মিশ্রণ ছাড়া একত্রিত ও সংরক্ষণই ছিল লক্ষ্য।
  • আসল ভুল ধারণা: কুরআনের বিন্যাস নিয়ে আপত্তি তোলেন যারা, তারা কুরআনের উদ্দেশ্য না জেনে এটিকে ইতিহাস বা সমাজ বিজ্ঞানের কিতাব ভাবেন।

আয়াত বিন্যাসে নবী ﷺ-র ভূমিকা:

  • নবী ﷺ নির্দেশ দিতেন কোন আয়াত বা সূরা কোথায় বসাতে হবে।
  • কোনো অংশ যদি সম্পূর্ণ সূরা না হয়, তবুও তিনি নির্দেশ দিতেন সেটি কোন সূরার কোন জায়গায় বসাতে হবে।
  • নামাযে, তেলাওয়াতে তিনি এই বিন্যাসই অনুসরণ করতেন।
  • সাহাবাদের অনুসরণ: সাহাবায়ে কেরাম এই বিন্যাস অনুযায়ী কুরআন মুখস্থ করতেন।
  • বিন্যাস ছিল ঐশী ও চূড়ান্ত: কুরআন যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে, তেমনি এর বিন্যাসও নবী ﷺ-এর মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশেই সম্পূর্ণ হয়েছিল।
  • হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না: এই বিন্যাসে কোনো মানুষের নিজ ইচ্ছায় পরিবর্তনের সুযোগ বা অধিকার ছিল না।

৯ম পয়েন্ট। কুরআন কিভাবে সংকলিত হলো

  1. নবুয়তের যুগে সংরক্ষণ
    • নামাজ ফরজ হওয়ায় কুরআন মুখস্থ করা আবশ্যক ছিল।
    • সাহাবিরা সাথে সাথে কুরআন মুখস্থ করতেন।
    • কাতিবরা খেজুরপাতা, হাড়, পাথরে লিখে রাখতেন।
  2. আবু বকর (রা)-এর সময়ে সংকলন
    • ইয়ামামার যুদ্ধে বহু হাফেজ সাহাবী শহীদ হন।
    • হযরত উমর (রা)-এর পরামর্শে হযরত আবু বকর (রা) কুরআন লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেন।
    • হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা) লিখিত ও মৌখিক দুই মাধ্যম মিলিয়ে নির্ভুল কপি প্রস্তুত করেন।
    • সংকলিত কপি উম্মুল মু’মিনীন হাফসা (রা)-এর কাছে সংরক্ষিত হয়।
  3. উসমান (রা)-এর সময়ে প্রামাণ্য কপি প্রচলন
    • ইসলাম বিস্তারের ফলে বিভিন্ন উচ্চারণে পাঠে ফিতনার আশঙ্কা দেখা দেয়।
    • হযরত উসমান (রা) একমাত্র কুরাইশী উচ্চারণে লিখিত নুসখা প্রণয়ন ও প্রচার করেন।
    • অন্য সব পাঠপ্রণালী বন্ধ করে দেন।
    • এই নুসখাগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়।
  4. আজকের কুরআন
    • বর্তমান কুরআন হযরত উসমান (রা) প্রণীত অনুলিপিরই প্রতিলিপি।
    • বিশ্বব্যাপী হাজারো কপি থাকা সত্ত্বেও এক হরফও পরিবর্তিত হয়নি।
    • এটি ইতিহাসে সবচেয়ে নির্ভুলভাবে সংরক্ষিত ঐশী গ্রন্থ।

১০ম পয়েন্ট। কুরআন অধ্যয়নের পদ্ধতি

  • মন-মস্তিষ্ক মুক্ত রাখা: কুরআন অধ্যয়নের শুরুতে পূর্বনির্ধারিত চিন্তাধারা, মতবাদ বা ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আন্তরিক ও নির্ভেজাল উদ্দেশ্যে পড়তে হবে।
  • প্রথম পাঠে সামগ্রিক ধারণা অর্জন: প্রথমবার কুরআন পড়ার সময় এর সামগ্রিক বিষয়, মৌলিক চিন্তা ও জীবনব্যবস্থার ভিত্তি বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। পড়ার সময় প্রশ্ন বা সংশয় নোট করতে হবে, পরে উত্তর খুঁজতে হবে।
  • বারবার পাঠ ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি: একবার পড়া যথেষ্ট নয়; বারবার পড়তে হবে, প্রতিবার নতুন ভঙ্গিতে পড়তে হবে। নোটবই নিয়ে বসে বিস্তারিত লেখা উচিত।
  • সংশয় ও প্রশ্ন সংরক্ষণ: প্রথম অধ্যায়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর না পেলে তা লিখে রেখে দ্বিতীয় বা পরবর্তী অধ্যায়ে উত্তর খুঁজতে হবে, ধৈর্য ধরে অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে হবে।
  • বিষয়ভিত্তিক গভীর অধ্যয়ন: কুরআনের বিভিন্ন বিষয় যেমন আদর্শ মানুষ, কল্যাণ ও ক্ষতির বিষয়াদি আলাদা আলাদা করে নোট করতে হবে এবং মনের মধ্যে গেঁথে নিতে হবে।
  • বিভিন্ন বিষয় ভাগ করে লেখা: যেমন ‘পছন্দনীয় মানুষ’ ও ‘অপছন্দনীয় মানুষ’, ‘কল্যাণের উপাদান’ ও ‘ক্ষতির কারণ’ এর মতো ভাগ করে নোটবইতে লিখে নিয়মিত অধ্যয়ন করতে হবে।
  • কুরআনের সামগ্রিক জীবনচিত্র অনুধাবন: বিভিন্ন বিষয় অনুধাবনের মাধ্যমে কুরআন থেকে জীবনব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ চিত্র স্পষ্ট করতে হবে।
  • সমস্যা নির্ধারণ করে অনুসন্ধান: জীবনের বিশেষ কোনো সমস্যা নিয়ে গবেষণা চালাতে চাইলে সেই সমস্যা সংক্রান্ত প্রাচীন ও আধুনিক জ্ঞান অধ্যয়ন করতে হবে, তারপর কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসন্ধান করতে হবে।
  • গভীর গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে উত্তর পাওয়া: আগেও পড়া আয়াতগুলোতেও গবেষণা করলে নতুন নতুন অর্থ বা তত্ত্ব সামনে আসবে।

১১ তম পয়েন্ট। কুরআনের প্রাণসত্তা অনুধাবন

  • কুরআন শুধু তাত্ত্বিক বই নয়: এটি কোনো মতবাদ বা চিন্তাধারার গ্রন্থ নয়, বরং জীবনের কাজ করার নির্দেশনা ও বাস্তব প্রয়োগের কিতাব।
  • আসল উপলব্ধি কাজের মধ্য দিয়ে: কুরআনের প্রাণসত্তা বুঝতে হলে শুধু পড়া নয়, এর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা ও কাজ করতে হবে।
  • ধর্মগ্রন্থ বা মাদ্রাসার শিক্ষার বাইরে: মাদ্রাসার পাঠ বা খানকাহয় বসে শুধু তত্ত্ব অনুধাবনেই সীমাবদ্ধ থাকা যথেষ্ট নয়।
  • দাওয়াত ও আন্দোলনের কিতাব: কুরআন একটি সক্রিয় আন্দোলনের বই, যা মানুষের নীরবতা ভেঙে বাইরের জগতের সঙ্গে লড়াই করার আহ্বান দেয়।
  • বাতিলের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ: কুরআন অনুসারীদেরকে সমাজের অবিচার, অবিশ্বাস, কুফর ও ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শিখায়।
  • সত্যনিষ্ঠ ও সক্রিয় জীবনের আহ্বান: কুরআন অনুসারীরা গৃহের বাইরে এসে সমাজে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হয়, শুধু নিঃসংগ জীবন নয়।
  • খিলাফতে ইলাহীয়ার দীর্ঘ সংগ্রাম: কুরআন ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলন ২৩ বছর ধরে নানা কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
  • সংঘাত ও দ্বন্দ্বের অংশ হতে হবে: কুরআনের পূর্ণ উপলব্ধি হবে শুধু যখন নিজেকে ঐ দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের অংশ হিসেবে দেখবেন এবং কাজ করবেন।
  • ‘কুরআনী সাধনা’: কুরআনের আয়াত ও সূরা বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতির স্মৃতি হয়ে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সামনে আসবে, এক ধরনের ধারাবাহিক সাধনা।
  • ব্যক্তিগত ও সামাজিক বাস্তবায়ন অপরিহার্য: ব্যক্তিগত জীবনে কুরআনের নির্দেশ মেনে চলা ছাড়া অথবা জাতির সামাজিক ব্যবস্থা কুরআনের পথে না গেলে এর প্রাণসত্তা উপলব্ধি সম্ভব নয়।

১২ তম পয়েন্ট। কুরআনী দাওয়াতের বিশ্বজনীনতা

  • কুরআনের মূল দাবি: কুরআন সমগ্র মানবজাতিকে পথ দেখাতে নাযিল হয়েছে।
  • নাযিলের সময়ের আরববাহিনী লক্ষ্য: অধিকাংশ আয়াত আরববাসীর ঐতিহাসিক, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে।
  • স্থানীয় ও সাময়িক বিষয়বস্তু থাকা স্বাভাবিক: বিশেষ সময় ও স্থানের মানুষের অবস্থান বুঝিয়ে, তাদের বিশ্বাস ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে যুক্তি দেওয়া হয়েছে।
  • সমগ্র মানবতার জন্য প্রযোজ্যতা: কেবল আরবদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; আয়াত ও নির্দেশনার মূল যুক্তি ও নীতি সব যুগ ও জাতির জন্য প্রযোজ্য।
  • কুরআনের প্রমাণ পদ্ধতি ও যুক্তি সার্বজনীন: শিরকের বিরুদ্ধে কুরআনের যুক্তি বিশ্বজনীন, যেকোনো যুগের মুশরিকের জন্য প্রযোজ্য।
  • সমগ্র মানবজাতির জীবনে প্রভাব: কুরআনের শিক্ষা ও দাওয়াত স্থান ও সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে চিরন্তন ও সার্বজনীন।
  • বস্তু নিরপেক্ষতা ও সময়ের সাথে খাপ খাওয়া: কোনো চিন্তা বা দর্শন পুরোপুরি বস্তু নিরপেক্ষ নয়; পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে হয়।
  • আন্তর্জাতিক দাওয়াতের বাস্তবতা: দাওয়াত শুরুতে স্থানীয় মানুষের কাছে পেশ করা এবং সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
  • আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ব্যবস্থার পার্থক্য:
    • জাতীয় ব্যবস্থা: নির্দিষ্ট জাতির শ্রেষ্ঠত্ব বা বিশেষ অধিকারের দাবি।
    • আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা: সকল মানুষের মর্যাদা ও সমান অধিকার নিশ্চিত করে।
    • সাময়িক ব্যবস্থা: সময়ের সাথে পরিবর্তিত ও অস্থায়ী।
    • চিরন্তন ব্যবস্থা: সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী খাপ খায়।
  • কুরআন একটি চিরন্তন, সার্বজনীন ব্যবস্থা: এটি শুধুমাত্র আরবের জন্য বা সাময়িক কোনো জাতির জন্য নয়, বরং সব যুগ ও জাতির জন্য আদর্শ জীবন ব্যবস্থা।

১৩ তম পয়েন্ট। পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান

  • কুরআন জীবন বিধান গ্রন্থ হলেও: সরাসরি সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ের সম্পূর্ণ বিস্তারিত নিয়ম-কানুন কুরআনে পাওয়া যায় না।
  • নামায ও যাকাতের বিধানও বিস্তারিত নয়: এমনকি নামায ও যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরযও কুরআনে বিস্তারিতভাবে প্রতিটি নিয়ম তুলে ধরা হয়নি।
  • অব্যক্ত কারণ: আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল শুধু কিতাব নাযিল করা নয়, বরং পয়গম্বরকে প্রেরণ করা — যিনি জীবন ব্যবস্থার বিস্তারিত বাস্তব রূপ স্থাপন করবেন।
  • গৃহনির্মাণের রূপকে উদাহরণ হিসেবে বোঝানো হয়েছে: নকশা (কুরআন) দেওয়ার পর একজন ইঞ্জিনিয়ার (পয়গম্বর) সেই নকশা অনুযায়ী পুরো ভবন নির্মাণ করেন। তাই কেবল নকশা দেখে অসংগতি আনা যুক্তিহীন।
  • কুরআন মূলনীতি ও মৌলিক বিষয় উপস্থাপন করে: খুটিনাটি বিবরণ না দিয়ে মূল নীতি, ভাবনা ও নৈতিক ভিত্তি প্রদান করে।
  • বৈজ্ঞানিক যুক্তি, প্রমাণ ও আবেদনের মাধ্যমে শক্তিশালী করণ: কুরআন চিন্তাগত ও নৈতিক ভিত্তি শুধু দেয় না, পাশাপাশি যুক্তি ও আবেগ দিয়ে তাদের দৃঢ় করে।
  • ইসলামী জীবন ব্যবস্থার কাঠামো নির্মাণ: কুরআন জীবনের বিভাগগুলোর মূল চৌহদ্দি ও সীমারেখা নির্দেশ করে।
  • বাস্তব গঠন ও নির্মাণ পয়গম্বরের দায়িত্ব: নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবন ব্যবস্থার আদর্শ কাঠামো তৈরি করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন।

১৪ তম পয়েন্ট। বৈধ মতপার্থক্য

  • কুরআন কঠোরভাবে নিন্দা করে এমন মানুষদের যারা: আল্লাহর কিতাব নাযিল হওয়ার পরও নিজেদের মধ্যে দলে বিভক্ত হয়, দলাদলি করে, ও নিজেদের দীনকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে ফেলে।
  • কিন্তু একই সময়ে দেখা যায়: দীন ও আইন বিষয়ে বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে আলেম, তাবেইন, সাহাবা এবং ইমামদের মধ্যেও ব্যাপক মতপার্থক্য ছিল।
  • সব জায়গায় একমত হওয়ার আয়াত নেই: এমন কোনো আয়াত নেই যা প্রতিটি বিষয়ে একমত থাকার নির্দেশ দেয়।
  • তাহলে প্রশ্ন: কুরআনের কঠোর নিন্দা কি ঐ আলেমদের মতপার্থক্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? না হলে কুরআন কোন ধরনের মতবিরোধের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে?

মতপার্থক্যের দুই ধরণ এবং কুরআনের রায়:

  1. প্রথম ধরনের মতপার্থক্য:
    • আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যে সবাই ঐক্যবদ্ধ।
    • কুরআন ও সুন্নাহ জীবন বিধানের উৎস স্বীকার।
    • ছোটখাটো বিষয়ে আলেমদের মধ্যে স্বতন্ত্র মত থাকতে পারে।
    • কেউ কাউকে দীন থেকে বহিষ্কৃত বা বিদ্বেষ প্রদর্শন করবে না।
    • যুক্তি ও প্রমাণের ভিত্তিতে মতামত দেওয়া ও গ্রহণ করা হয়।
    • সমাজের উন্নতি ও বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন হিসেবে এই মতপার্থক্যকে দেখা হয়।
  2. দ্বিতীয় ধরনের মতপার্থক্য:
    • মৌলিক দীনীয় বিষয় বা ইমান-বিশ্বাসে বিভাজন সৃষ্টি।
    • নিজের মতকে ‘সত্য মুসলিম’ ও অন্যদের ‘বহিরাগত’ ঘোষণার প্রচার।
    • দলগঠন করে অন্যদের বিরুদ্ধে কুৎসা, বিদ্বেষ ও দীন থেকে বহিষ্কার করার প্রচেষ্টা।
    • এতে সমাজে বিভাজন, বিদ্বেষ, ও ধ্বংসাত্মক দলাদলি তৈরি হয়।
  3. কুরআন এই ধরনের মতবিরোধ, দলাদলি ও ফেরকাবন্দির কঠোর নিন্দা করে।

    কুরআন কী চাইছে?:

    • বুদ্ধিমত্তার মুক্ত অবস্থান: ইসলামী সমাজে জ্ঞানী ও চিন্তাশীল মানুষের মতপার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয়।
    • মৌলিক বিশ্বাসে একতা বজায় রাখা: ইসলামী নীতি ও মূল বিশ্বাসের প্রতি সম্মান ও আনুগত্য থাকতে হবে।
    • দ্বিতীয় ধরনের মতবিরোধ থেকে বিরত থাকা: যা কেবল বিভাজন, বিদ্বেষ ও উম্মাহর ক্ষতি করে।
    • নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এমন বৈধ মতবিরোধকে প্রশংসিত করেছেন।

    পাঠকের জন্য পরামর্শ

    • কুরআনের গভীর অধ্যয়ন ও তাফসীর (ব্যাখ্যা) মনোযোগ দিয়ে পড়া প্রয়োজন।
    • যেসব প্রশ্ন মনে হয়, সংশ্লিষ্ট অংশে তার জবাব খোঁজার চেষ্টা করা।
    • মতবিরোধের বিষয়ে সচেতন থাকা ও মৌলিক ইসলামী ঐক্য রক্ষা করা।
    • দ্বন্দ্ব, দলাদলি, ও বিভাজনের পথ এড়িয়ে চলা।

    Top


    দাওয়াত সংক্রান্ত আয়াত আল ইমরান-১০৪, ইউসূফ-১০৮, আন নাহল-১২৫, হামীম আস সাজদাহ-৩৩ মায়েদা-৬৭

    আল ইমরান-১০৪:
    وَلۡتَكُنۡ مِّنۡكُمۡ اُمَّۃٌ یَّدۡعُوۡنَ اِلَی الۡخَیۡرِ وَ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡكَرِ ؕ وَ اُولٰٓئِكَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰۴
    (১০৪) তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা (লোককে) কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কার্য থেকে নিষেধ করবে। আর এ সকল লোকই হবে সফলকাম।

    ইউসূফ-১০৮:
    قُلۡ هٰذِهٖ سَبِیۡلِیۡۤ اَدۡعُوۡۤا اِلَی اللّٰهِ ۟ؔ عَلٰی بَصِیۡرَۃٍ اَنَا وَ مَنِ اتَّبَعَنِیۡ ؕ وَ سُبۡحٰنَ اللّٰهِ وَ مَاۤ اَنَا مِنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ ﴿۱۰۸
    ১০৮. বলুন, এটাই আমার পথ, আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি ডাকি জেনে-বুঝে, আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও । আর আল্লাহ কতই না পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।

    আন নাহল-১২৫,
    اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّكَ بِالۡحِكۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ وَ جَادِلۡهُمۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ ؕ اِنَّ رَبَّكَ هُوَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ضَلَّ عَنۡ سَبِیۡلِهٖ وَ هُوَ اَعۡلَمُ ۱۲۵- بِالۡمُهۡتَدِیۡنَ
    তোমার রবের পথে আহবান কর হিকমাত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে আলোচনা কর সুন্দরভাবে। তোমার রাব্ব ভাল করেই জানেন কে তাঁর পথ ছেড়ে বিপথগামী এবং কে সৎ পথে আছে।

    হামীম আস সাজদাহ-৩৩
    وَ مَنۡ اَحۡسَنُ قَوۡلًا مِّمَّنۡ دَعَاۤ اِلَی اللّٰهِ وَ عَمِلَ صَالِحًا وَّ قَالَ اِنَّنِیۡ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ﴿۳۳
    আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’?

    মায়েদা-৬৭ :
    یٰۤاَیُّهَا الرَّسُوۡلُ بَلِّغۡ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡكَ مِنۡ رَّبِّكَ ؕ وَ اِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلۡ فَمَا بَلَّغۡتَ رِسَالَتَهٗ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡصِمُكَ مِنَ النَّاسِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡكٰفِرِیۡنَ ﴿۶۷
    হে রসূল! তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার কর, যদি না কর তাহলে তুমি তাঁর বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করলে না। মানুষের অনিষ্ট হতে আল্লাহ্ই তোমাকে রক্ষা করবেন, আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে কক্ষনো সৎপথ প্রদর্শন করবেন না।

    দাওয়াত সংক্রান্ত ১টি হাদীস মুখস্ত,
    عَن حُذَيفَةَ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ وَالَّذِي نَفْسي بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنْ المُنْكَرِ أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللهُ أنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَاباً مِنْهُ ثُمَّ تَدْعُوْنَهُ فَلا يُسْتَجَابُ لَكُمْ رواه الترمذي، وَقالَ حديث حسن
    (১৬০৪) হুযাইফাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ আছে! তোমরা অবশ্যই ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে, তা না হলে শীঘ্রই আল্লাহ তাআলা তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের উপর আযাব পাঠাবেন। অতঃপর তোমরা তাঁর কাছে দু’আ করবে; কিন্তু তা কবুল করা হবে না। (আহমাদ, তিরমিযী ২১৬৯, সহীহুল জামে ৭০৭০)<

    মাসয়ালা: বিভিন্ন নামাজ সংক্রান্ত। GO

Top

"সর্বস্বত সংরক্ষিত© ২০২৩ এস এম হোমিওপ্যাথি মেডিকেল সেন্টার; ব্লগঃ ডিজাইনে SIAAM