ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য দরস, বই নোট, বিষয়ভিত্তিক আয়াত-হাদিস ও মাসয়ালা সংকলন
# দারস তৈরী -সূরা বাকারা (১-৫ নং আয়াত) # বিষয়: হাদীস সংকলনের ইতিহাস # ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ সংক্রান্ত আয়াত # ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ সংক্রান্ত হাদিস #তাহারাত সংক্রান্ত সম্পর্কিত মাসায়েল
الٓـمّٓ ﴿۱﴾ ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَیْبَ ۚۖۛ فِیْهِ ۚۛ هُدًی لِّلْمُتَّقِیْنَ ﴿۲﴾ الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِالْغَیْبِ وَیُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوۃَ وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ ﴿۳﴾ وَالَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ وَمَاۤ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ ۚوَ بِالْاٰخِرَۃِ هُمْ یُوْقِنُوْنَ ﴿۴﴾ اُولٰٓئِكَ عَلٰی هُدًی مِّنْ رَّبِّهِمْ ٭ وَ اُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ﴿۵
অর্থঃ (১) আলিফ লাম মীম [এর প্রকৃত তাৎপর্য আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না]। (২) এই তো কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, আছে মোত্তাকীদের (অন্যায় পরিহারকারী, আল্লাহভীরু, সৎকর্মশীল ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের) জন্য পথনির্দেশ; (৩) যারা অদৃশ্য সত্যকে বিশ্বাস করে, নামায আদায় করে, আর আমি তাদেরকে যা দান করেছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে; (৪) যারা তোমার কাছে যা নাযিল করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে (অন্য নবীদের কাছে) যা নাযিল করা হয়েছিল তা বিশ্বাস করে; আর পরকালের প্রতি তারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। (৫) এ ধরনের লোকেরাই তাদের প্রভুর সঠিক পথে আছে এবং এরাই সফলকাম।
নামকরণ হয়েছে 'আল-বাকারাহ' (গাভী) শব্দটি থেকে। এই নামকরণটি এই সূরার ৬৭ থকে ৭৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত বনী ইসরাঈলের গাভী জবাই করার ঘটনা থেকে এসেছে।
মহানবী (সঃ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে আসার ফলে ইসলাম প্রচার ব্যাপক হতে থাকে। তখন কুরাইশ, ইয়াহুদি, খ্রিস্টান এবং মুনাফিকরা ইসলামের গতিরোধ করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তারা ইসলামের প্রতি অমূলক নানারকম অপবাদ প্রচার করতে থাকে এবং পবিত্র কুরআন আল্লাহর বাণী হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহমূলক উক্তি করতে থাকে।
উদ্দেশ্য: আল্লাহ তা‘আলা কাফির, মুশরিক, ইয়াহুদি, খ্রিস্টান ও মুনাফিকদের সেই মিথ্যা অপবাদের প্রতিবাদে সূরা আল-বাকারা নাযিল করেন। এ সূরায় ইসলাম বিদ্বেষীদের সমস্ত অপবাদের জবাব দেওয়া হয়।
তাফসীরে নুরুল কুরআন: মালিক ইবন সাইফ নামক এক ইয়াহুদির অপপ্রচারের জবাব দিতে এই সূরা নাযিল হয়, যাতে ঘোষণা করা হয়— "এটা সেই কিতাব, যাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই।"
আল-কুরআনের সবচেয়ে দীর্ঘ সূরা এটি। মহানবী (সঃ)-এর হিজরতের পর মদীনায় অবতীর্ণ হয়।
বৈশিষ্ট্য | বিবরণ |
---|---|
আয়াত সংখ্যা | ২৮৬ |
রুকু সংখ্যা | ৪০ |
কেন্দ্রীয় বিষয় | ইসলামের অধিকাংশ মূলনীতি, শরীআতের বিধান (সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাত, বিবাহ-তালাক ইত্যাদি) এবং মুসলিম উম্মাহর দিকনির্দেশনা। |
আলোচনার দু'টি প্রধান ধারা:
(১) الۤمّٓ
ব্যাখ্যা: এগুলোকে 'হুরূফে মুক্বাত্ত্বাআত' বলা হয়। আল্লাহই এর অর্থ সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত। নবী করীম (সাঃ) বলেন, এর প্রতিটি অক্ষরে নেকী রয়েছে, যার প্রতিদান দশগুণ করে পাওয়া যায়।
(২) ذٰلِكَ الۡكِتٰبُ لَا رَيۡبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلۡمُتَّقِيۡنَ
অনুবাদ: এই সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য।
ব্যাখ্যা: এ কিতাবের অবতরণ যে আল্লাহর নিকট থেকে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এটি মুত্তাকীদের জন্য পথপ্রদর্শনকারী।
(৩) الَّذِيۡنَ يُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَيۡبِ وَيُقِيۡمُوۡنَ الصَّلٰوةَ وَمِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ يُنۡفِقُوۡنَۙ
অনুবাদ: যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।
ব্যাখ্যা: অদেখা বিষয়সমূহ (গায়েবের) যেমন— আল্লাহর সত্তা, জান্নাত, জাহান্নাম, ফেরেশতা ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। রসূল (সাঃ)-এর তরীকা অনুযায়ী নামায কায়েম করা এবং ফরয ও নফল উভয় প্রকার সদকা বা দান করা।
(৪) وَالَّذِيۡنَ يُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَيۡكَ وَمَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِكَ ۚ وَبِالۡاٰخِرَةِ هُمۡ يُوۡقِنُوۡنَ
অনুবাদ: এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের উপর যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের উপর যা তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর আখেরাতকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে।
(৫) اُولٰٓئِكَ عَلٰى هُدًى مِّنۡ رَّبِّهِمۡ ۖ وَاُولٰٓئِكَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ
অনুবাদ: তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম।
বৈশিষ্ট্য | প্রমাণ (আয়াত) | গুরুত্ব |
---|---|---|
১. গায়েব বা অদৃশ্যে বিশ্বাসী | (২:২) | ইসলামি আকীদা-বিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তি। |
২. সালাত কায়েম করে | (২:২) | আনুগত্যের বাস্তব নমুনা ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন। |
৩. আল্লাহর দেওয়া রিয্ক থেকে ব্যয় করে | (২:২) | অর্থের মোহ থেকে মুক্তি ও মানুষের অধিকার পূরণ। |
৪. আসমানি কিতাবে বিশ্বাস করে | (২:৩) | মানব জাতির পথ নির্দেশনার জন্য নাযিল হওয়া কিতাব স্বীকার করা। |
৫. আখিরাত জীবনে সুদঢ় বিশ্বাসী | (২:৩) | কর্মফলের প্রতি দৃঢ় আস্থা, যা জীবনকে অর্থপূর্ণ করে। |
রাসুল (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে হাদীসের পবিত্রতা রক্ষা এবং কুরআনের বিশদ ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনার জন্য হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হয়।
এর সূচনা হয় উমাইয়া খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এর যুগে এবং তা পূর্ণতা লাভ করে আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের যুগে।
সামগ্রিক বিশ্লেষণে হাদীস সংকলনের ইতিহাসকে মোট পাঁচটি প্রধান স্তরে ভাগ করা হয়:
ইসলামের প্রাথমিক যুগে **কুরআনের সাথে হাদীসের সংমিশ্রণের আশঙ্কা** থাকায় মহানবী (সাঃ) প্রথমে সাহাবীগণকে হাদীস লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন।
নিষেধাজ্ঞার হাদীস:
لا تكتبوا عنى غير القران ومن كتبه فليمحه
কিন্তু পরবর্তীতে অনুমতির পর লেখার মাধ্যমে হাদীস সংরক্ষণ করা হয়।
রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর বিশিষ্ট সাহাবীগণ ব্যক্তিগতভাবে কিছু সংখ্যক হাদীস গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন:
সাহাবী (রাঃ) | সংকলিত গ্রন্থের নাম |
---|---|
হযরত আলী (রাঃ) | সহীফায়ে আলী |
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) | সহীফায়ে সাদেকাহ |
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) | সহীফায়ে আনাস ইবনে মালেক |
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) | সহীফায়ে আবু হুারায়রা |
উমাইয়া খলিফা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এর যুগেই **সরকারিভাবে** হাদীস সংকলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
খলিফার নির্দেশ: ইলম ও আলিমদের বিলুপ্তির আশঙ্কায় তিনি নির্দেশ জারি করেন:
أنظر ما كان من حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم فاكتبه فانی خفت دروس العلم وذهاب العلماء-
আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিলের যুগ হলো হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলনের **সোনালি যুগ** (তৃতীয় শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে পঞ্চম শতাব্দী)।
এই যুগে কয়েকজন শ্রেষ্ঠ মনীষীর মাধ্যমে হাদীসের **ছয়টি বিশুদ্ধ গ্রন্থ** (সিহাহ সিত্তাহ) সংকলন হয়।
উমাইয়া খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ও আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাওয়াক্কিল (র)-এর অবদান মুসলিম জাতির নিকট চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আল্লাহর পথে ব্যয়ের (ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ) গুরুত্ব সম্পর্কিত তিনটি কুরআনের আয়াত এবং একটি হাদীস নিচে দেওয়া হলো:
مَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَهُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ كَمَثَلِ حَبَّۃٍ اَنۡۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ فِیۡ كُلِّ سُنۡۢبُلَۃٍ مِّائَۃُ حَبَّۃٍ ؕ وَ اللّٰهُ یُضٰعِفُ لِمَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ ﴿۲۶۱
২৬১. যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশ শস্যদানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।لَنۡ تَنَالُوا الۡبِرَّ حَتّٰی تُنۡفِقُوۡا مِمَّا تُحِبُّوۡنَ ۬ؕ وَ مَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ شَیۡءٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِهٖ عَلِیۡمٌ ﴿۹۲
৯২. তোমরা যা ভালবাস তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারবেনা; এবং তোমরা যা কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ তা জ্ঞাত আছেন।مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یُقۡرِضُ اللّٰهَ قَرۡضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَهٗ لَهٗ وَ لَهٗۤ اَجۡرٌ كَرِیۡمٌ ﴿ۚ۱۱
১১. এমন কে আছে যে আল্লাহকে দেবে উত্তম ঋণ? তাহলে তিনি বহু গুণে এটাকে বৃদ্ধি করবেন তার জন্য। আর তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।عَنْ أَسْمَاءَ، قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " انْفَحِي - أَوِ انْضَحِي أَوْ أَنْفِقِي - وَلاَ تُحْصِي فَيُحْصِيَ اللَّهُ عَلَيْكِ وَلاَ تُوعِي فَيُوعِيَ اللَّهُ عَلَيْكِ
আসমা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ তুমি ছি িয়ে দাও অথবা বিলিয়ে দাও অথবা ব্যয় কর। গুণে গুণে রেখ না, তাহলে আল্লাহও তোমাকে গুণে গুনে দিবেন। আর গুটিয়ে রেখ না তবে আল্লাহ ও তোমার থেকে গুটিয়ে রাখবেন। (সহীহ মুসলিমঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন-২২৪৮)