বিষয়: মহান রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণায় আমাদের তৎপরতা
প্রফেসর মো. শফিকুল ইসলাম
وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ (৭) وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ (৬) وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ (৫) وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ (৪) وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ (৩) قُمْ فَأَنْذِرْ (২) يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (১)
- হে কম্বল মুড়ি দিয়ে শায়িত ব্যক্তি
- উঠুন এবং সতর্ক করুন
- এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ত্ব ঘোষণা করুন
- আর আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন
- প্রতিমা থেকে দূরে থাকুন
- অধিক প্রাপ্তির আশায় কারো প্রতি অনুগ্রহ করবেন না
- এবং আপনার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করুন।
নামকরণ
প্রথম আয়াতের আল-মুদ্দাস্সির শব্দটি এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। আল-মুদ্দাসির (এ) অর্থ বস্তু বা কম্বল আচ্ছাদনকারী। এখানে আল-মুদ্দাস্সির (প্রে) শব্দ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সা.-কে সম্বোধন করা হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়কাল
সূরা আল-মুদ্দাসসির দুটি অংশে নাযিল হয়। প্রথম অংশে সূরার প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল হয়।
✦ নামকরণ
প্রথম আয়াতের ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) শব্দটিকে এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) অর্থ বস্ত্র বা কম্বল আচ্ছাদনকারী। এখানে ‘আল-মুদ্দাস্সির’ (الْمُدَّثِّرُ) শব্দ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সা.-কে সম্বোধন করা হয়েছে।
✦ নাযিল হওয়ার সময়কাল
সূরা আল-মুদ্দাসসির দু’টি অংশে নাযিল হয়। প্রথম অংশে সূরার প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল হয়। এটি সর্বপ্রথম নাযিলকৃত সূরাহ আলাকের পর নাযিল হয়। অর্থাৎ সম্ভবত এ আয়াতগুলো ৬১০ খ্রি. শাওয়াল মাসে নাযিল হয়।
দ্বিতীয় অংশে অষ্টম আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত নাযিল হয়। এটি প্রকাশ্যভাবে ইসলামের প্রচার শুরু হওয়ার পর প্রথমবার মক্কায় হজের মওসুম সমাগত হলে নাযিল হয়।
✦ সূরার বিষয়বস্তু
- সূরার প্রথম সাতটি আয়াতে নবুওয়াতের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্মনীতি বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মহান রবের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা বা তাওহিদের প্রতি আহ্বান এবং আহ্বানের ক্ষেত্রে রাসূল সা.-এর শারীরিক ও আত্মিক প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
- ৮-৫৩ আয়াতে সত্য দ্বীন অমান্যকারীদের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে কিয়ামতের দিবসে তাদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
- ৫৪-৫৬ আয়াতে বলা হয়েছে, এ কুরআন হচ্ছে মানুষের জন্য উপদেশ। কিন্তু এ উপদেশ কবুল করার জন্য আল্লাহ কাউকে বাধ্য করেন না। যে গ্রহণ করবে সে-ই উপকৃত হবে; আর যে গ্রহণ করবে না সে-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
✦ নির্বাচিত আয়াতসমূহের আলোচ্য বিষয়
সূরাহ আল-মুদ্দাস্সিরের প্রথম সাতটি আয়াতে নবুওয়াতের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্মনীতি সংক্রান্ত ছয়টি নির্দেশনা প্রদান হয়েছে।
প্রথম নির্দেশ : قُمْ فَأَنْذِر অর্থাৎ উঠুন এবং বিশ্ববাসীকে স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপনের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করুন।
দ্বিতীয় নির্দেশ : وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ অর্থাৎ মহান রবের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করুন ও প্রতিষ্ঠা করুন।
তৃতীয় নির্দেশ : وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ অর্থাৎ পোশাক, দেহ, অন্তর ও মনকে পবিত্র করুন।
চতুর্থ নির্দেশ : وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ অর্থাৎ প্রতিমা পূজা ও যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থাকুন।
পঞ্চম নির্দেশ : وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ অর্থাৎ পার্থিব প্রতিদানের আশায় কাউকে দান ও অনুগ্রহ করা থেকে বিরত থাকুন।
ষষ্ঠ নির্দেশ : وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ অর্থাৎ সর্বাবস্থায় রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করুন।
নির্বাচিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যাঃ
প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যা:
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ "ওহে বস্ত্র আচ্ছাদিত ব্যক্তি।"
আরবীতে কাউকে ডাকার জন্য 'হরফে নিদা' (حرف نداء) ব্যবহার করা হয়। এখানে 'ইয়া আইয়ুহা' (يا أيها) 'হরফে নিদা'। আর যাকে ডাকা হয় বা সম্বোধন করা হয় সেটি মুনাদা। এ আয়াতে মুহাম্মদ সা.-কে আল-মুদ্দাস্সির (الْمُدَّثِّرُ) তথা 'ওহে বস্ত্রাচ্ছাদিত ব্যক্তি' বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এটি প্রীতিপূর্ণ সম্বোধন। মহান আল্লাহ অন্য সকল নবীকে আহ্বান করার সময় নাম ধরেই সম্বোধন করেছেন। কিন্তু মুহাম্মদ সা.-কে কখনও 'ইয়া মুহাম্মদ' বলেননি, বরং তাঁকে অতি আদর করে সম্বোধন করেছেন। এটি রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি বিশেষ সম্মান।
সূরাহ আলাক নাযিলের পর কিছুকাল পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সা.-এর ওপর ওহি নাযিল বন্ধ থাকে। এ সময়কে 'ফাতরাতুল ওহি' বলে। সে সময় রাসূলুল্লাহ সা. এতো কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। ওহি নাযিলের বিরতির শেষভাগে একদিন রাসূল সা. পবিত্র মক্কায় পথ চলাকালে ওপর দিক থেকে কিছু আওয়াজ শুনতে পান। তিনি ওপরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পান যে ফেরেশতা জিবরিল (আ) আকাশে একটি ঝুলন্ত আসনে উপবিষ্ট আছেন। ফেরেশতাকে এমতাবস্থায় দেখে তিনি ভীত-আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাড়াতাড়ি গৃহে ফিরে বললেন: زَمِّلُونِي (আমাকে চাদরাবৃত কর, আমাকে চাদরাবৃত কর)। অতঃপর তিনি চাদরাবৃত হয়ে শুয়ে পড়লেন।
সেমতাবস্থায় রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে ডেকে বলা হচ্ছে, হে আমার প্রিয় বান্দা মুহাম্মদ সা.! আপনি চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছেন কেন? আপনার ওপরে তো একটি বিরাট মহৎ কাজের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এ দায়িত্ব পালন করার জন্য আপনাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উঠে দাঁড়াতে হবে। অতঃপর তাঁকে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে ছয়টি কাজের নির্দেশ দেয়া হয়। (ইবনে জারির)
দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যা:
قُمْ فَأَنْذِرْ "উঠুন অতঃপর সতর্ক করুন।"
এখানে ‘কুম’ (قُمْ) এবং ‘আনযির’ (أَنْذِر) দু’টি শব্দে একটি আয়াত। দু’টি শব্দই ‘আমর’ বা আদেশ সূচক। ‘কুম’ (قُمْ) অর্থ উঠুন, দণ্ডায়মান হোন, কর্মে তৎপর হোন ইত্যাদি। আর ‘আনযির’ (أَنْذِر) অর্থ সতর্ক করুন, ভয় দেখান ইত্যাদি।
এ আয়াতে মহান আল্লাহ নির্দেশ দেন, হে কম্বলজড়ানো ব্যক্তি! আপনার কম্বল জড়িয়ে শয্যা গ্রহণের অবকাশ কোথায়? আপনার প্রতি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার এক বিরাট দায়িত্ব চাপানো হয়েছে, আপনি উঠুন। আমার একত্ববাদ প্রচার করুন এবং যারা আমার সত্তায়, গুণে ও ক্ষমতায় আমার সাথে অন্যান্য বস্তুকে শরিক করে তাদেরকে এটার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করুন।
রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি এ নির্দেশ এমন এক সময় ও পরিবেশে অবতীর্ণ হয়, যখন মক্কাসহ সমগ্র আরবের লোক ও জনপদগুলো শিরকে নিমজ্জিত ছিল আর তিনি ছিলেন একাকী। তাঁর সঙ্গী-সাথী কেউই ছিল না। এহেন পরিবেশে সর্বজন বিরোধী একটি মতাদর্শ নিয়ে দণ্ডায়মান হওয়া এবং তা জনসম্মুখে প্রচার করা কত বড় বিরাট ঝুঁকির ব্যাপার ছিল তা একটু চিন্তা করলেই বোধগম্য হয়। এহেন পরিবেশের মধ্যেই আল্লাহ বললেন, আপনি তৌহিদের পতাকা নিয়ে দণ্ডায়মান হোন এবং মানুষকে তৌহিদের পরিপন্থী আকিদা-বিশ্বাসের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতে থাকুন। এটাই আপনার প্রথম কাজ। এ যেন মহা স্রোতের বিপরীতে চলার এক কঠিন নির্দেশ।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে রাসূলকে সা. ‘নাযির’ তথা সতর্ককারীর দায়িত্বসহ প্রেরণের কথা বলা হয়েছে।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا.
"হে নবী! আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে।" (সূরাহ আহযাব : ৪৫)
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ.
"আমি তোমাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছি সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী বানিয়ে। আর এমন কোন সম্প্রদায় অতিক্রান্ত হয়নি যার মধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি।" (সূরাহ ফাতির : ২৪)
إِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ أَنْ أَنْذِرْ قَوْمَكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (১) قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ.
"আমি নূহকে তার কওমের কাছে পাঠিয়েছিলাম, যেন তিনি তার কওমের লোকদের ওপর এক ভীষণ কষ্টদায়ক আযাব আসার পূর্বেই তাদেরকে সাবধান করে দেন। তিনি বলেছিলেন, হে আমার দেশবাসী! আমি তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট সাবধানকারী।" (সূরা নূহ : ১-২)
তৃতীয় আয়াতের ব্যাখ্যা:
وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ "আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।"
সূরাহ আল-মুদ্দাসসিরে দ্বিতীয় নির্দেশনায় মহান আল্লাহ বলেন, হে নবী! মানুষ আমার মহানত্ব, বিরাটত্ব ও অসীমত্বের কথা ভুলে আমার জমিনে শয়তানের কথামত রাজত্ব পরিচালনা করছে। আমার জমিনে এখন বাতিলের রাজত্ব চলছে। লাত, মানতের পূজা-অর্চনা করা হচ্ছে। অথচ জমিনের মালিক হলাম আমি আল্লাহ। আমার জমিনে শয়তানের রাজত্ব চলতে পারে না। মানবরচিত মতবাদ চলতে পারে না। আপনি উঠুন এবং আল্লাহর তাকবির ঘোষণা করুন। 'ওয়া রাব্বাকা ফাকাব্বির' (وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ) অর্থাৎ সব জায়গায় 'আল্লাহু আকবার' (الله اكبر) ধ্বনিত হবে। জগতের সর্বত্রই থাকবে আমার শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ। মানুষের আকিদা-বিশ্বাস হতে শুরু করে তাদের কর্মময় জীবনের প্রতিটি স্তরে থাকবে আমারই শ্রেষ্ঠত্বের ফলিতরূপ। একজন মু'মিন 'আল্লাহু আকবার' (الله اكبر)-এর তাকবির বা স্লোগান ছাড়া কোনো মানুষের তাকবির বা স্লোগান দিতে পারে না। এটি কুফরি স্লোগান। আল্লাহ বলেন, জমিনের মালিক আমি আল্লাহ। এ জমিন এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে সবই আমার হুকুমে তৈরি হয়েছে। সুতরাং এ জমিনে আইন চলবে একমাত্র আল্লাহর। এ সম্পর্কে সূরাহ আরাফের ৫৪তম আয়াতে বলা হয়েছে,
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
"সাবধান! সৃষ্টি যার, আইন চলবে একমাত্র তার। বরকতময় আল্লাহই বিশ্ব জগতের মালিক।"
পৃথিবীতে যতজন নবী ও রাসূল আগমন করেছেন, এটিই ছিলো তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। এ ব্যাপারে সূরাহ আন-নাহলের ৩৬তম আয়াতে বলা হয়েছে,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ.
"প্রত্যেক জাতির মধ্যে আমি একজন রাসূল পাঠিয়েছি এবং তার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি যে, “আল্লাহর বন্দেগি করো এবং তাগুতের বন্দেগি পরিহার করো।”
সকল নবীরই প্রধান কাজ ছিলো মহান রবের একত্ববাদের দিকে আহ্বান করা। সূরাহ আরাফের ৫৯, ৬৫, ৭৩ ও ৮৫তম আয়াতে হযরত নূহ, হুদ, সালেহ, শুয়াইব (আ) এর দাওয়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে,
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ.
"হে আমার দেশবাসী! আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই।"
তাই একজন নবীর প্রথম কাজই হলো, অজ্ঞ ও মূর্খ লোকেরা এ পৃথিবীতে যাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ মেনে চলছে তাদের সবাইকে অস্বীকার করবে এবং গোটা পৃথিবীর সামনে উচ্চকণ্ঠে এ কথা ঘোষণা করবে যে, এ বিশ্বজাহানে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ নেই।
ইসলামে 'আল্লাহু আকবার' (الله اكبر) তথা 'আল্লাহই শ্রেষ্ঠ' কথাটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। 'আল্লাহু আকবার' ঘোষণার মাধ্যমেই আযান শুরু হয়। 'আল্লাহু আকবার' এ কথাটি বলে মানুষ সালাত শুরু করে এবং বারবার 'আল্লাহু আকবার' বলে ওঠে ও বসে। কোন পশুকে জবাই করার সময়ও 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' বলে জবাই করে। জন্মের সময় শিশুর কানে দেয়া হয় 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনি আবার মৃত্যুর পর সালাতু যানাজার মাধ্যমেও দেয়া হয় 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনি। তাকবির ধ্বনি বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সর্বাধিক স্পষ্ট ও পার্থক্যসূচক প্রতীক। কারণ, মহানবী সা. আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার মাধ্যমেই রিসালাতের কাজ শুরু করেছিলেন। অতএব একজন মুমিনের 'আল্লাহু আকবার' ছাড়া অন্য কোনো স্লোগান হতে পারে না।
চতুর্থ আয়াতের ব্যাখ্যা:
وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ "আর আপনার পোশাক পবিত্র রাখুন।"
এ আয়াতে 'সিয়াব' (ثِيَابْ) ও 'তাহির' (طَهِّرْ) দু'টি শব্দ রয়েছে। 'সিয়াব' (ثِيَابْ) শব্দটি 'সাওবুন' (ثَوْبً) এর বহুবচন। একে 'লিবাস' (لباس)ও বলা হয়। এর আসল অর্থ কাপড় বা পোশাক। এর রূপক অর্থ অন্তর, মন, দেহ, কর্ম ইত্যাদি।
অতএব, এ আয়াতে নবীকে সা. নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, হে নবী! আপনি স্বীয় পোশাক ও দেহকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র রাখুন, পোশাকের নৈতিক দোষত্রুটি হতে মুক্ত রাখুন। অর্থাৎ পোশাকে অহংকার, গৌরব, রিয়া বা লৌকিকতা থেকে মুক্ত রাখুন। অনুরূপভাবে অন্তর ও মনকে ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে এবং অসৎচরিত্রতা থেকে মুক্ত রাখুন।
ইসলাম মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হতে শিক্ষা দেয়। হাদিসে পবিত্রতাকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। তাই মুমিনগণকে সর্বাবস্থায় দেহ, স্থান ও পোশাক বাহ্যিক অপবিত্রতা থেকে এবং অন্তরকে অভ্যন্তরীণ অপবিত্রতা থেকে পবিত্র রাখার প্রতি সচেষ্ট হতে হবে।
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা., ইবরাহিম নাখয়ী, শা’বী, আতা, মুজাহিদ, কাতাদাহ, সায়ীদ ইবন যুবাইর, হাসান বসরী (রহ.) ও অন্যান্য বড় বড় মুফাসসির এ আয়াতের তাৎপর্যে বলেছেন, আপনার চরিত্র পবিত্র ও নিষ্কলুষ রাখুন ও সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি হতে নিজেকে মুক্ত রাখুন।
রাসূলুল্লাহ সা. যে সমাজে ইসলামের দাওয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন তা শুধু আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিক আবিলতার মধ্যেই নিমজ্জিত ছিল না বরং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে পর্যন্ত সে সমাজের লোক অজ্ঞ ছিল। এসব লোককে সব রকমের পবিত্রতা শিক্ষা দেয়া ছিল রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাজ। তাই তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তিনি যেন তাঁর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জীবনের সকল পবিত্রতার সর্বোচ্চ মান বজায় রাখেন।
নবী করীম সা. স্বভাবগতভাবেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করতেন। তাই তিনি যেন সচেতনতার সাথে পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখেন তারই শিক্ষা রয়েছে এই আয়াতে। নৈতিক দিক দিয়ে পোশাক পবিত্রতার অর্থ হচ্ছে- পোশাক এমন হতে হবে যাতে অহংকার প্রকাশ পাবে না, তাতে কুরুচির ছাপও থাকবে না।
মহান আল্লাহ পবিত্রতাকে পছন্দ করেন। যেমন- পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, "অবশ্যই মহান আল্লাহ অধিক হারে তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে ভালোবাসেন।" (সূরা আল-বাকারাহ : ২২২)
পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল সা. বলেন, "নিশ্চয়ই আল্লাহ পরিচ্ছন্ন, তিনি পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসেন।" (তিরমিজি)
অনুরূপভাবে সূরাহ মায়িদার ষষ্ঠ আয়াতে সালাতের পূর্বে পবিত্রতা তথা অজুর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
এক কথায় বলা যেতে পারে, এই আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে-
- ১. পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
- ২. পোশাক পরিচ্ছদ নৈতিক দোষত্রুটি থেকে পবিত্র রাখা।
- ৩. সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি হতে নিজ চরিত্রকে পবিত্র রাখা।
অতএব দায়ী হিসেবে আমাদের সকলকে পবিত্রতার ক্ষেত্রে এ তিনটি দিকেই সতর্ক থাকতে হবে।
পঞ্চম আয়াতের ব্যাখ্যা:
وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ "অধিক প্রতিদানের আশায় কারো প্রতি অনুগ্রহ করো না।"
অত্র আয়াতে ‘আর-রুজ্যুন’ (الرُّجْزَ) থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ‘আর-রুজ্যুন’ (الرُّجْزَ) শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক একটি শব্দ।
- প্রসিদ্ধ তাবিঈ মুজাহিদ, ইকরামা, কাতাদাহ, যুহরী, ইবন যায়েদ, আবূ সালামা (রহ.) প্রমুখ বলেছেন, ‘আর-রুজ্যুন’ (الرُّجْزَ) অর্থ মূর্তি। অর্থাৎ মূর্তিগুলোকে বর্জন করো, এগুলোর কাছেও যেয়ো না।
- ইবন আব্বাস রা. বলেছেন, এর অর্থ হলো পাপাচার।
- আবু আলিয়া এবং রবী (রহ.) বলেছেন, এর অর্থ অপবিত্রতা এবং গুনাহ।
- ইমাম যাহহাক বলেছেন, এর অর্থ শিরক।
- কালবী বলেছেন, এর অর্থ আজব।
- আল্লামা সাবুনি বলেছেন, এর দ্বারা সর্বপ্রকার খারাপ জিনিস উদ্দেশ্য হতে পারে।
অতএব আয়াতের অর্থ হলো, হে নবী! আপনি প্রতিমা পূজা এবং যাবতীয় গুনাহ ও অপবিত্রতা পরিত্যাগ করুন।
এখানে অপবিত্রতা বলতে, আকিদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার অপবিত্রতা হতে পারে, নৈতিক চরিত্র ও কাজ-কর্মের অপবিত্রতা হতে পারে আবার শরীর ও পোশাক-পরিচ্ছদ এবং ওঠা-বসা চলাফেরার অপবিত্রতাও হতে পারে। অর্থাৎ চিন্তা-চেতনা, আচার- ব্যবহার, ও দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজকর্ম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের সামান্যতমও যেন অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য মুহাম্মদ সা.-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর ও মনকে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে এবং কুচরিত্র থেকে মুক্ত রাখুন।
এ বিষয়ে যদি কেউ প্রশ্ন করে, রাসূলুল্লাহ সা. তো আগে থেকেই প্রতিমা পূজা ও যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্ত ছিলেন, তার ধারে কাছেও ছিলেন না। তাহলে তাঁকে এ আদেশ দেয়ার অর্থ কী? এর উত্তরে আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সা.-কে নির্দেশের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদীকে শিক্ষা দেয়া উদ্দেশ্য।
ষষ্ঠ আয়াতের ব্যাখ্যা:
وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ “অধিক প্রতিদানের আশায় কারো প্রতি অনুগ্রহ করো না।”
এ আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে কয়েকটি মেসেজ দেয়া হয়েছে।
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া পার্থিব বিনিময়ের আশায় সকল প্রকার দান-খয়রাত এবং মানব কল্যাণমূলক কাজ করতে এখানে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে কোনো কাজ যদিও ভালো মনে হয়, আর সে কাজের মধ্যে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য না থাকে, তবে সে কাজ আল্লাহর কাছে ভালো বলে গণ্য হবে না।
২. আমরা যারা ইসলামী আন্দোলনের কাজ করছি, এটি নিঃসন্দেহে আল্লাহর একটি বড় হুকুম পালন করছি। তবে এ কাজটি যদি ব্যক্তিস্বার্থের জন্য হয় বা নিজের কোনো উপকার হাসিলের জন্য হয়, তাহলে এ আন্দোলন করার মাধ্যমে নাজাত পাওয়া যাবে না।
৩. আমরা যারা সার্বক্ষণিকভাবে দ্বীনের পথে বা দ্বীনি আন্দোলনের পথে কাজ করছি তাদের এ কথা ভাবার বা মনে করার সুযোগ নেই যে, আমি দ্বীনের অনেক উপকার করলাম। বরং মনে রাখতে হবে যে, কোনো নেক কাজ কিংবা দ্বীনের কাজ করে আল্লাহর কোনো উপকার হয় না, যা উপকার বা কল্যাণ হয় তা নিজেরই উপকার বা কল্যাণ হয়।
এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের দিকে দৃষ্টি দিলে আমাদের ধারণা আরো পরিষ্কার হবে।
১. قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ.
“বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।” (সূরা আনআম : ১৬২)
২. إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ.
“আমি একমুখী হয়ে স্বীয় লক্ষ্য ঐ সত্তার দিকে করেছি, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরেকদের মধ্যে শামিল নই।” (সূরা আনআম, ৬ : ৭৯)
৩. يَمُنُّونَ عَلَيْكَ أَنْ أَسْلَمُوا قُلْ لَا تَمُنُّوا عَلَيَّ إِسْلَامَكُمْ بَلِ اللَّهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ أَنْ هَدَاكُمْ لِلْإِيمَانِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (১৭)
“তারা মুসলমান হয়ে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করেছ মনে করো না। বরং আল্লাহ্ ঈমানের পথে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাক।”
৪. وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ.
“(নূহ, হুদ, সালেহ, লূত, শুআইব (আ) জাতির উদ্দেশ্যে বলেন) এ কাজে আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদানের প্রত্যাশী নই। আমাকে প্রতিদান দেয়ার দায়িত্ব তো রাব্বুল আলামিনের।” (শুআ’রা : ১০৯; ১২৭; ১৪৫, ১৬৪, ১৮০)
৫. عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ.
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তোমাদের চেহারা এবং ধন-সম্পদের দিকে তাকান না। তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও ‘আমলসমূহের দিকে। (সহীহ মুসলিম; সুনানু ইবন মাজাহ)
৬. أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً: إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّهُ، أَلاَ وَهِيَ القَلْبُ.
নুমান ইবন বাশীর রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জেনে রাখ, নিশ্চয়ই মানুষের শরীরে একটি গোশতের টুকরা আছে- তা বিশুদ্ধ থাকলে গোটা শরীর সুস্থ থাকে। আর তা বিনষ্ট হলে গোটা শরীরই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে যায়। জেনে রাখো ঐ গোশতের টুকরাটি হলো মানুষের কলব বা আত্মা। (সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম)
৭. عَنِ الْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: ্রذَاقَ طَعْمَ الْإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا.
আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, রাসূল সা. বলেছেন, সে ব্যক্তি ঈমানের প্রকৃত স্বাদ লাভ করেছে, যে ব্যক্তি পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মদ সা.-কে নবী হিসেবে মেনে নিয়েছে। (জামি তিরমিজি; সহীহ মুসলিম)
৮. عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ، وَأَبْغَضَ لِلَّهِ، وَأَعْطَى لِلَّهِ، وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيمَانَ.
আবু উমামা আল-বাহলি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তির ভালোবাসা ও শত্রুতা, দান করা ও না করা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই হয়ে থাকে, প্রকৃতপক্ষে সে-ই পূর্ণ ঈমানদার। (সুনানু আবি দাউদ)
সপ্তম আয়াতের ব্যাখ্যা:
وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ "এবং তোমার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো।"
অত্র আয়াতে সবর সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সবর বা ধৈর্য তিন প্রকার।
- ১. ‘আস-সাবরু আলাল মা‘আসী’ তথা অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার জন্য ধৈর্য।
- ২. ‘আস-সাবরু আলাত ত্বাওয়া’ তথা আনুগত্যে ওপর ধৈর্য।
- ৩. ‘আস-সাবরু আলাল মাসিবাহ’ তথা বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ। অতএব সকল অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করা আবশ্যক।
এ আয়াতটি নবুয়তের একেবারে প্রথম দিকের আয়াত এবং মহান রবের শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্ব ঘোষণা নিয়ে মুহাম্মদ সা. এখনো ময়দানে নামেননি। তাই তিনি এই ঘোষণা নিয়ে ময়দানে নামলে তার সাথে কী কী নেতিবাচক ঘটনা ঘটতে পারে সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সা.-কে আগেই সবরের শিক্ষা দিয়েছেন।
এ পথে চলতে গিয়ে যে কোন বিপদ-মুসিবতই আসুক না কেন প্রভুর উদ্দেশ্যে সেসব বিপদের মুখে ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে এবং অত্যন্ত অটল ও দৃঢ়চিত্ত হয়ে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে।
আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা বা প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গেলেই খোদাদ্রোহী শক্তির সাথে বিরোধ হবেই। এ জন্যই সকল নবী বা রাসূলের সাথে সমসাময়িক শাসকদের বিরোধ হয়েছে। আজও যারা বলে আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই। তাদের ওপরও জুলুম নির্যাতন চলে। অতএব এ বাধা, নির্যাতন ছিল, আছে এবং থাকবে। এ অবস্থায় ধৈর্যের সাথে সামনে অগ্রসর হতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সা. প্রথম অহি প্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে খাদিজা রা.-কে ঘটনাটি বর্ণনা করলে তিনি তাঁকে ওয়ারাকা ইবন নওফিলের কাছে নিয়ে গেলে ওয়ারাকা সব কথা শুনেই রাসূল সা.-কে বলেছিলেন, ইনি সে দূত (النَّامُوسُ) যাঁকে আল্লাহ মূসা (আ) এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম। আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কাওম তোমাকে বের করে দেবে। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তাঁরা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব। এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা রা. ইন্তেকাল করেন।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও আল-হাদিসে সবরের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হয়েছে। আমরা এ আয়াতের ব্যাখ্যার জন্য এ সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিস অধ্যয়ন করতে পারি। (যেমন- সূরা আল-বাকারাহ : ১৫৩; আলে ইমরান : ২০০; আনফাল : ৪৬; সোয়াদ : ১৭; কাফ : ৩৯)
নির্বাচিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যাঃ
আয়াতসমূহের শিক্ষা
- আল্লাহর দ্বীনি দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার ভয়-ভীতি কিংবা মনের কষ্টের কারণে ঘরে শুয়ে বসে থাকা যাবে না।
- রাসূল সা.-এর অনুকরণে আমাদেরকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা দিতে হবে এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
- আয়াতে পবিত্রতার শিক্ষা আমাদের পরিধেয় বস্ত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং মুমিন ও দায়ী হিসেবে বাহ্যিক পবিত্রতার পাশাপাশি সকল প্রকার শিরক, কুফর, ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে অন্তর ও চরিত্রকে পবিত্র রাখতে হবে।
- আল্লাহর একত্ববাদ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে। বৈষয়িক কোনো উদ্দেশ্য এখানে থাকবে না।
- পার্থিব বিনিময় পাওয়ার আশায় অন্যকে দান করা যাবে না। কারো কোনো উপকার করলে তার বিনিময়ের আশা করা যাবে না। হাদিয়া বা উপঢৌকন বিনিময় পাওয়ার আশায় দেওয়া যাবে না। এমনকি আল্লাহর কোনো বন্দেগি বা নেক কাজ করে কিংবা দ্বীনের কাজ করে মনে করা যাবে না যে আল্লাহর মহা উপকার করলাম। কেননা কোনো নেক কাজ কিংবা দ্বীনের কাজ করে আল্লাহর কোনো উপকার হয় না, যা উপকার বা কল্যাণ হয় তা নিজেরই উপকার ও কল্যাণ হয় মনে করতে হবে।
- এ কাজ করতে গিয়ে বাতিলের আক্রমণ ও বাধার সম্মুখীন হলে চুপ থাকা যাবে না বরং দৃঢ়পদে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে ধৈর্য অবলম্বনের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
পরিশেষ
আমরা সবাই মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, হে আল্লাহ! আমাদেরকে সকল প্রকার বাহ্যিক ও আত্মিক পাপাচার ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে দৃঢ়তার সাথে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে টিকে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
Top
বই নোট: ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
মূল নামঃ ইসলামী দাওয়াত আউর তরিকে কাম
লেখক- সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
বইটির গুরুত্ব
১. বইটি নিরেট একটি সাংগঠনিক বই।
২. দায়ীদের উদ্দেশ্যে বইটি রচিত।
৩. যারা দ্বীনকে জীবন উদ্দেশ্য হিসাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত তাদের উদ্দেশ্যে ।
৪. ইসলামকে জীবনাদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠাকারীদের জন্য বইটি গুরুত্বপূর্ণ।
৫. এটি ১৯৪৫ সালের ১৯শে এপ্রিল দারুল ইসলাম পাঠান কোটে অনুষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর বার্ষিক সম্মেলনে প্রদত্ত আমীরে জামায়াতের ভাষণ।
ভুমিকায় ৩টি বিষয়ের আলোচনা ঃ
আমাদের দাওয়াতে হতাশার দিক
১. আমাদের আন্দোলন শুষ্ক, নীরস ও স্বাদহীন।
২. আমাদের দাওয়াত দুনিয়ার রাজনৈতিক বাজারে একটি অচল পণ্য।
৩. আমাদের কর্মনীতিতে আন্দোলনকে তীব্র ও জনগণকে আকৃষ্ট করতে বর্তমান কালের উপায় উপকরণ নেই।
আমাদের দাওয়াতে আশার দিক
১. ধীরে ধীরে বহু লোক আমাদের দাওয়াতে আকৃষ্ট হচ্ছে।
২. সম্মেলন সমুহে দূর-দুরান্ত থেকে লোকজন যোগদান করছে।
৩. এ সকল লোকদের আকর্ষণ নিশ্চিত সত্যের দিকে।
তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা
১. “মুসলিম লীগ” মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে ভারত বিভাগ করে পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলন করে।
২. অপর দিকে “কংগ্রেস” অখন্ড ভারত রক্ষার আন্দোলনে জোরালো ভুমিকা রাখে।
৩. এ সময় জামায়াত রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংএ যোগ না দিয়ে নীরবে দাওয়াত-সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে।
সম্মেলনের উদ্দেশ্য
অতীতের কাজ যাচাই করা, দোষ-ত্রুটিসমূহ অনুধাবন করা এবং তাহা দূর করবার জন্য চিন্তা করার অবসর লাভ করাই এই সম্মেলনের লক্ষ্য।
ক. আমাদের সম্মেলন সমুহের উদ্দেশ্য হলো
১. সদস্যগণের পরস্পর পরিচিতি, সংঘবদ্ধ ও গভীরভাবে মিলিত হওয়া।
২. পারস্পরিক পরামর্শ ও সহযোগিতার উপায় উদ্ভাবন করা।
৩. নিজেদের সাংগঠনিক কাজকে সামনের দিকে অগ্রসর করা।
৪. বিপদ, সমস্যা, বাধা-বিপত্তি সমুহ দূর করার পন্থা নির্ধারণ করা।
৫. অতীত কাজের দোষ-ত্রুটি অনুধাবন ও তা দূর করতে চিন্তা করার অবসর লাভ।
৬. সমর্থকদেরকে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের দাওয়াত ও কাজ বুঝার সুযোগ করে দেয়া।
৭. সত্য নীতি সম্পর্কে মনের ভ্রান্ত ধারণা দূর হলে তারা জামায়াতে যোগদান করবে।
খ. সাধারণ লোকেরা কেন সম্মেলনে আসে
১. মুষ্টিমেয় কিছু লোক আল্লাহর নামে যে কাজ শুরু করেছে, তা সুক্ষ দৃষ্টিতে যাচাই করার জন্য।
২. প্রকৃত পক্ষে মুষ্টিমেয় লোকদের কাজ আল্লাহর জন্য কিনা তা অনুসন্ধান করার জন্য।
আমাদের দাওয়াত
ক. দাওয়াতী কাজে অভিযোগ বা বাধা
১. দাওয়াত দিতে গেলেই বলা হয়, আমরা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার দাওয়াত দিই।
২. আমাদের লক্ষ্য বুঝানো হয়-আমরা ক্ষমতা দখলের জন্য রাজনীতি করি।
৩. আমাদেরকে পার্থিব স্বার্থবাদী আখ্যা দেয়া হয়।
খ. অভিযোগ কারীদের ধারণা
১. অথচ মুসলমানরা তো দ্বীন-ইসলাম ও পরকালের জন্যই কাজ করে।
২. হুকুমত দাবী করার বস্তু নয়, ধার্মিক জীবন যাপনের কারণে আল্লাহর তরফ থেকে আসে।
গ. অভিযোগের কারণ ৩টি
১. প্রকৃত তত্ত্ব না বুঝার কারণে।
২. চালাকীর সাথে করে, যাতে সাধারণ লোক সত্যের আন্দোলন/দাওয়াত থেকে বিরত থাকে।
৩. আলেম-পীরেরা কেন রাজনীতির দাওয়াত দেয় না, তারাই ইসলাম বেশী বুঝে (নিজ)।
ঘ. আমাদের উদ্দেশ্য বা চুড়ান্ত লক্ষ্য
১. মানুষের সামগ্রিক জীবনে ইসলাম নির্ধারিত পরিপূর্ণ বিপ্লব সৃষ্টি করা।
২. নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য-১টি মুসলিম জাতি গঠন, নবীদের কাজই এখন আমাদের।
ঙ. আমাদের দাওয়াত ৩টি দফাঃ
১. আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণঃ সাধারণতঃ সকল মানুষকে বিশেষত মুসলমানদেকে আহবান জানাই।
২. মুনাফেকী ত্যাগঃ যারা মুসলমান হওয়ার দাবী করে, তাদেরকে মুনাফেকী ও কর্মে বৈষম্য দূর করে ইসলামে পরিপূর্ণ প্রবেশের দাওয়াত দিয়ে থাকি।
৩. নেতৃত্বের আমুল পরিবর্তন ঃ বাতিল, ফাসেকী ও কাফিরদের নেতৃত্বের আমুল পরিবর্তন করে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নেক বান্দাদের হাতে সোপর্দ করা।
চ. খোদার বন্দেগী সম্পর্কে কিছু লোকের ভ্রান্ত ধারণা
১. নিজকে বান্দা মনে করাই যথেষ্ট, নৈতিক-সমষ্টিগত জীবনে দাসত্ব না করলেও ক্ষতি নেই।
২. আল্লাহকে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও মাবুদ স্বীকার করতে হবে এবং বাস্তব জীবনে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব থেকে আল্লাহকে অপসারিত করা অসংগত হবে না।
৩. ধর্মীয় জীবনে আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত, হালালহারামের কয়েকটি শর্ত মানাই বন্দেগী।
৪. বৈষয়িক ব্যাপারে খোদার বন্দেগী হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। যেমন-তামাদ্দুন, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি।
আমাদের সংগ্রাম
ছ. কাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম?
- ১. যতখানি কাফের জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই।
- ২. ততখানি তিব্রতার সাথে বন্দেগীর এই ভুল ধারণার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম।
জ. কেন আমাদের সংগ্রাম?
- উল্লেখিত ধারণা সমূহ দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তি ও রূপকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে দিয়েছে।
মুনাফেকীর মূলকথা
ক. মুনাফেকীর নীতি ৪টি:
- ১. ঈমান ও দ্বীনের সম্পূর্ণ বিপরীত জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত দেখে সন্তুষ্ট হওয়া।
- ২. এর আমূল পরিবর্তন করে নিজের জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা না করা।
- ৩. প্রতিষ্ঠিত জীবন ব্যবস্থা অনুকূল মনে করে তা থেকে নিজের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা।
- ৪. কিছু লোক চেষ্টা করলেও তা আরেকটি ফাসেকী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে করে।
খ. খালেস-নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমানের পরিচয়:
- ১. যে জীবন ব্যবস্থার প্রতি ঈমান আনবে, তা জীবন-বিধান ও আইন হিসাবে চালু করবে।
- ২. এই পথে যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক, আমাদের প্রাণ ব্যাকুল ও কাতর হয়ে উঠবে।
- ৩. প্রকৃত ঈমান তার বিকাশে সামান্যতম বাধা বরদাশত করবে না।
গ. সুস্পষ্ট ভ্রান্ত ধারণা:
- ১. কিছু দেশে ইসলামের কিছু আইন-নীতি অক্ষতিকর মনে করে অনুগ্রহ করে চলতে দেয়।
- ২. সমগ্র জীবন দ্বীনের বিপরীত নিয়মে চলে, এতে ঈমানের ক্ষতি হয় না বলে মনে করে।
- ৩. এমনকি সেখানে কুফুরী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে স্থায়ী নিয়তি মনে করা হয়।
ঘ. বান্দাকে মুনাফেকী হতে পবিত্র করাই আমাদের লক্ষ্য:
- ১. খোদার বন্দেগীর সঠিক ধারণা অনুযায়ী নিষ্ঠার সাথে প্রচেষ্টা চালাব।
- ২. আল্লাহ প্রদত্ত জীবন পদ্ধতি পূর্ণ জীবনে অনুসরণ করব।
- ৩. জীবনের ক্ষুদ্র কাজেও বাতিলের প্রভাব বরদাশত করবো না।
কর্মীর বৈসাদৃশ্যের তত্ত্বকথা
ক. কর্মীয় বৈসাদৃশ্য কাকে বলে:
- ১. কথা ও কাজের গরমিলকে বলে।
- ২. মুখে ঈমানের দাবী রেখে কাজে তার বিপরীত করাকে।
- ৩. বিভিন্ন নীতি অনুসরণ করাকে।
- ৪. বন্দেগীর বিপরীত কাজ করাকে।
খ. বৈসাদৃশ্য, অসামঞ্জস্য, মুনাফেকী ও বহুরুপী কাজের উদাহরণ:
- ১. তাওহীদ, রেসালত, আখেরাত, শরীয়তকে মানার দাবী করে বৈষয়িক স্বার্থ লাভের জন্য বস্তুবাদী, তাওহীদের বিপরীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করার জন্য যাওয়া।
- ২. ঈমানের দাবী করে খোদার দুশমনদের রচিত আইনে স্থাপিত আদালতের বিচারের উপর নির্ভর করি।
- ৩. মসজিদে নামাজ আদায় ও বাইরে আল্লাহকে ভুলে গিয়ে নফসের অনুসরণ করি।
- ৪. একদিকে আল্লাহর নিকট প্রতিশ্রুতি প্রদান, অন্যদিকে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মূর্তির পূজা করা।
গ. দ্বীন সম্পর্কে বর্তমান মুসলমানদের অবস্থা:
- ১. ঈমান ও ইসলামের স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট হবে।
- ২. তাওহীদ-রেসালতের সাক্ষ্য ও নামাজ-রোজাসহ কয়েকটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনেই যথেষ্ট।
- ৩. বাস্তব জীবনে দ্বীন ও ঈমান বিরোধী কর্মনীতি অবলম্বন করলে ঈমানের কোন ক্ষতি নেই।
ঘ. যার ফলশ্রুতিতে ক্ষতি হচ্ছে:
- ১. ফাসেকী, কাফেরী, পাপ, নাফরমানী ও যুলুমকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
- ২. ঈমানের বিপরীতে মুসলমানরা সময়, শ্রম, যোগ্যতা ও জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে-তা বুঝার জ্ঞানটুকু নেই। উদাহরণ: লবণের খনিতে বিচ্ছিন্নভাবে যত লোক প্রবেশ করবে তারা লবণের সাথে মিশে যাবে।
ঙ. আমাদের আহবান:
- ১. সম্পূর্ণ একমুখী নীতি-আদর্শের অনুসারী হয়ে দ্বীনের বিপরীত কাজ-কর্মের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।
- ২. ঈমানের দাবীকে গভীরভাবে উপলব্ধি ও তা পূরণ করার আহবান।
নেতৃত্বের মৌলিক পরিবর্তনের আবশ্যকতা
- ক. ঈমানের দাবী / মুমীনের অনিবার্য দাবী - বর্তমান জীবন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিপ্লব সৃষ্টি করা
- ১. যিনি নিজেকে খোদার দাসত্বের নিকট সোপর্দ করেন।
- ২. জীবনে কোনো প্রকার মুনাফেকী ও বৈসাদৃশ্যের ফাঁক না রাখেন।
- ৩. একনিষ্ঠ মুমীন হওয়ার চেষ্টা করেন-তার উপর।
- খ. বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি কিসের উপর স্থাপিত?
- ১. কুফরীর উপর - পুঁজিবাদ বা বস্তুবাদ (আমেরিকা)
- ২. নাস্তিকতার উপর - কমিউনিজম ও সেকুলারিজম (তুরস্ক)
- ৩. শিরকের উপর - রাজতন্ত্র (সৌদি আরব, কুয়েত)
- ৪. ফাসেকীর উপর - জাতীয়তাবাদ
- ৫. অসচ্চরিত্রতার উপর - গণতন্ত্র (বাংলাদেশ)
- গ. নেতৃত্বের মৌলিক পরিবর্তন কেন দরকার? এ কাজ না করলে ক্ষতি ৩টি:
- ১. দুনিয়াতে খাঁটি মুসলমান হিসাবে জীবন যাপন করা সম্ভব নয়।
- ২. খোদার দাসত্বকে জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
- ৩. ভবিষ্যত বংশধরদের ইসলামের উপর বিশ্বাসী রাখা সম্ভব নয়।
- ১. খোদার সন্তোষ অর্জন,
- ২. ধবংস ও বিপর্যয় থেকে সমাজকে রক্ষা,
- ৩. শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বস্তি প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যে পৌঁছতে বাধা: প্রতিষ্ঠিত অসৎ নেতৃত্ব।
- ঙ. কেন বিশ্বে অশান্তি-যুলুম বৃদ্ধি পায়? বিবেকের মতামত কী?
- ১. কারণ: বিশ্বের নেতারা অসৎ, ফাসেক, ফাজির, খোদাদ্রোহী, শয়তানের দাসানুদাসগণ।
- ২. ফলাফল: যুলুম, নির্যাতন, অশান্তি, বিপর্যয় ও অত্যাচার বৃদ্ধি পাবে।
- চ. মুসলমানের অপরিহার্য কাজ:
- ১. পথভ্রষ্ট নেতৃত্ব খতম করা।
- ২. কুফর ও শিরকের প্রাধান্য বিচূর্ণ করা।
- ৩. দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সাধনা করা।
নেতৃত্ব পরিবর্তন কীভাবে হবে
- ক. বিশ্ব পরিচালনার জন্য কী দরকার?
- ১. যোগ্যতা: জ্ঞান-বিজ্ঞান
- ২. শক্তি: আধুনিক প্রযুক্তি সমূহ
- ৩. বৈশিষ্ট্য: মৌলিক মানবীয় গুণাবলী
- খ. যাদের হাতে আল্লাহ নেতৃত্ব দেবেন তাদের গুণাবলী ৪টি:
- ১. ঈমান: যাদের খাটি ঈমান আছে।
- ২. সততা: যারা প্রকৃতভাবে সৎ।
- ৩. মানবিক যোগ্যতা: যাদের দেশ পরিচালনার অপরিহার্য গুণাবলী আছে।
- ৪. শক্তি: যাদের শক্তি ও ক্ষমতা কাফেরদের চেয়ে বেশি আছে। (সূরা নূর-৫৫)
- ১. দল গঠন: ঈমান ও সৎ লোকদের একটি দল গঠন করা। (সূরা আলে ইমরান-১০৩)
- ২. সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা: দুনিয়ার নেতৃত্ব কাফেরদের হাত থেকে সৎ ও ঈমানদারদের হাতে সোপর্দ করা। (সূরা তাওবা-৩৩, সূরা ফাতাহ-২৮, সূরা সফ-৯)
- ঘ. আমাদের দাওয়াতের মূল আবেদন:
- ১. ঈমানদার ও সৎ লোকদের নিয়ে দল গঠন।
- ২. নিষ্ঠাবান ইসলামের অনুসারী হওয়া।
- ৩. তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত চরিত্র হবে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ।
- ৪. সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ যোগ্যতার অধিকারী হবে।
বিরুদ্ধতা ও তার কারণ
- ক. কাদের থেকে বিরোধিতা আসে?
- ১. মুসলমান: সর্বপ্রথম দাওয়াতে বিরোধিতা আসে মুসলমানদের পক্ষ থেকে।
- ২. দ্বীনদার: আবার তাও মুসলমানদের মধ্যে যারা দ্বীনদার তারাই আগে বাধা দেয়।
- ৩. ইসলামী দল: তার মধ্যেও আবার বেশি তৎপর ধর্মপন্থী দলগুলো।
- খ. আমাদের দাওয়াত সম্পর্কে অমুসলিমদের মন্তব্য:
- ১. অমুসলিমরা আজ পর্যন্ত বিরোধিতার জন্য সম্মুখে অগ্রসর হয় নাই।
- ২. ইসলাম সম্পর্কে একজন হিন্দু, শিখ ও ইংরেজও সত্য নয় একথা বলে নাই।
- ৩. এর বিরোধিতা করার প্রয়োজনীয়তাও প্রকাশ করে নাই।
- ৪. তারা একথাও বলেছে-যদি দেশে ইসলামের দাওয়াত আগেই পেশ করা হত এবং মুসলমানরা যদি তা কায়েম করার চেষ্টা করতো তবে দেশের অবস্থা ভিন্নরূপ হত।
- ১. আমাদেরকে কেউ সম্মুখ দিক থেকে আক্রমণ করতে পারে না।
- ২. তাই তারা পিছন দিক থেকে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করে বলে:
- ঘ. দাওয়াত ঠিক আছে, তবে সমস্যা আছে:
- ১. দায়ীদের মধ্যে কিছু দোষ-ত্রুটি আছে।
- ২. এই কাজের জন্য সাহাবীদের মতো লোক প্রয়োজন।
- ৩. এই যুগে এই দাওয়াত চলার মতো নয়, ইহা অচল মতবাদ।
- ৪. মুসলমানদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এ দাওয়াত গ্রহণ করা যাবে না।
- ঙ. বিরোধিতাকারীদের পরিচয়:
- ১. সর্বপ্রথম যারা বাধা দিবে- পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব।
- ২. ধার্মিক ও মুত্তাকীরা-যাদের কপালে সিজদার চিহ্ন পড়ে গেছে।
- ৩. যারা ২৪ ঘন্টা ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা করে তারাও বিরোধিতা করতে সংকোচ করে না।
- ৪. তাদের পুত্র-ভ্রাতা কিংবা আত্মীয়দের আন্দোলনে যোগদান আদৌ সহ্য করতে পারে না।
- চ. বিরোধিতার পরিবর্তে পুষ্প ও প্রশংসা আসত যদি আমরা:
- ১. দাওয়াতকে নিছক একটি জ্ঞান-গবেষণামূলক আন্দোলন হিসাবে পেশ করতাম।
- ২. এই উদ্দেশ্য বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে লোকদের আহবান না জানাইতাম।
- ছ. নবী-রাসূলদের আন্দোলনের বিরোধিতার কারণ:
- ১. কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের বিরোধিতা করার কারণ:
- ২. শিরকের ভিত্তিতে স্থাপিত জীবন/সমাজ ব্যবস্থাকে চূর্ণ করে খালিস তাওহীদের ভিত্তিতে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে পেশ করার কারণে তারা তা গ্রহণে প্রস্তুত ছিল না।
- ৩. বংশীয় প্রথা, আত্মগৌরব, আভিজাত্য, পারিবারিক বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে তাওহীদের ভিত্তিতে জাতি গঠন করার আহবান জানানোর কারণে।
- ৪. অর্থনৈতিক ও পারিবারিক স্বার্থ-পরতা ও লোভ-লালসার প্রবৃত্তি ত্যাগ করে নৈতিক চরিত্রের মূলনীতিসমূহকে বাস্তব জীবনের ভিত্তি হিসাবে স্থাপিত করতে বলার কারণে। রাসূল (সা.) এই লক্ষ্যে একটি আন্দোলনের মাধ্যমে লোকদের সংঘবদ্ধ করে দেশের তাহযীব তামাদ্দুন ও নৈতিকতাকে আদর্শ দিয়ে পরিবর্তন করার চেষ্টা সাধনা করেছেন।
- জ. বাতিল সমাজ ব্যবস্থার সাথে মুসলমানদের সমঝোতার ধরণ:
- ১. মুসলমানরা বাতিল ব্যবস্থার সাথে সমঝোতার ফলে তাদের উপর বিরোধিতা আসে নাই।
- ২. এই সমঝোতায় বৈষয়িক ও ধর্মীয় সুযোগ সুবিধা ছিল।
- ৩. পরহেজগারীর ধুম পড়া লোক পর্যন্ত বাতিল সমঝোতার সাথে জড়িত।
- ৪. বাতিল মতবাদের অধীনে তাকওয়া, ইবাদাতসহ কয়েকটি অনুষ্ঠান পালনেই যথেষ্ট মনে করা।
- ৫. বহু আধ্যাত্মিক লোকের বাতিলের সাথে সমঝোতার ফলে আধ্যাত্মিকতার মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় নাই।
- ৬. কুফর, জাহেলিয়াত, ফাসেকী ও ভ্রান্ত আকীদার প্রতিবাদ ও ত্রুটি বর্ণনা করে মুখে সাহাবা যুগের মনোমুগ্ধকর চিত্র অঙ্কন করা ইসলামের কর্তব্য পালনে যথেষ্ট মনে করা হয়েছে।
- ৭. আত্মীয়-স্বজন, আগামীদেরকে বাতিল সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রাখা সম্পূর্ণ হালাল।
- ঝ. আমাদের মারাত্মক অপরাধ কী / কেন বিরোধিতা করা হচ্ছে?
- ১. বাতিলের সাথে সকল সুযোগ সুবিধা ত্যাগ করতে বলছি।
- ২. নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দ্বীনের অনুসরণ করতে আহবান জানাচ্ছি।
- ৩. সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জান-মাল, সময়-শ্রম উৎসর্গ করে চেষ্টা সাধনা করার আহবান জানাচ্ছি।
- ঞ. আমাদের দাওয়াতকে সত্য বলে মেনে নেওয়া হলে তাকে যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে:
- ১. স্বার্থের কুরবানী বরদাশত করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অথবা
- ২. স্বীকার করার পর মনের দুর্বলতার দোহাই দিয়ে আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকতে হবে।
- ট. এই পথ অবলম্বন করা সহজ নয়, কারণ এতে:
- ১. পরকালের গ্যারান্টি নষ্ট হয়ে যাবে।
- ২. আধ্যাত্মিকতার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে।
- ঠ. এই জন্য বড় একটি দল তৃতীয় একটি পথ অবলম্বন করে:
- ১. আমাদের দাওয়াত ও আন্দোলনকে ভুল বলতে পারে না।
- ২. সত্যতা স্বীকার করলেও মূলনীতিকে বাদ দিয়ে বিশেষ কোনো ব্যক্তির বিষোদগার করে ঘোলাটে করে আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে।
- তারা যুক্তি দিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করলেও খোদার মুখ বন্ধ করতে পারবে না।
আমাদের কর্মনীতি
- ১. কুরআন
- ২. হাদিস এবং
- ৩. নবী-রাসুলদের কর্মনীতি
- খ. যারা দাওয়াত গ্রহণ করে তাদের প্রতি কর্মনীতি/আহবান:
- ১. খোদার দাসত্ব অনুযায়ী জীবন গড়ে তুলতে বলি।
- ২. কাজে নিজের ঐকান্তিকতার পরিচয় দিতে বলি।
- ৩. ঈমানের বিপরীত কাজ হতে নিজকে পবিত্র রাখতে বলি।
- গ. আন্দোলনে যোগ দিয়ে যে কর্মনীতি ত্যাগ করতে হবে:
- ১. বড় হওয়ার লক্ষ্যে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে, তাদের গগণচুম্বি স্বপ্ন-প্রাসাদ ধুলিস্যাৎ করতে হয়।
- ২. অবৈধ পথে অর্জন করা ধন-সম্পদ ত্যাগ করে সর্বহারা হতে হয়।
- ৩. জীবিকা নির্বাহের শরীয়ত বিরোধী পথ ত্যাগ ও পবিত্র পন্থা গ্রহণ করা, তা যতই নিকৃষ্ট হোক।
- ঘ. উপরোক্ত কর্মনীতিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাথমিক যে অগ্নি পরীক্ষা/বাঁধা/সমস্যা আসে:
- ১. প্রথমে পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয় স্বজন, তার ঈমানের সাথে দ্বন্দে লিপ্ত হয়।
- ২. অনেক মানুষের মায়া-মুহব্বত ও স্নেহ নীড় বোলতার বাসায় পরিণত হয়।
- ঙ. প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে যে তাকওয়ার সৃষ্টি হয়:
- ১. যে তাকওয়া ফিকাহ শাস্ত্রের মানদন্ডের উত্তীর্ণ নয়।
- ২. যে তাকওয়া খানকা শরীফের মানদন্ডে অসম্পূর্ণ।
- ৩. কিন্তু সে তাকওয়া বিশ্ব পরিচালনার গুরু দায়িত্ব ও আমানাতের দুর্বহ ভার বহন করার মতো।
- ৪. খানকার তাকওয়া একশত ভাগের এক ভাগও বহন করার মতো নয়।
- নিকটবর্তী পরিবেশে সকল লোকদের মধ্যে দাওয়াত বিকীর্ণ করা।
- ছ. দাওয়াতের ফলাফল বা লাভ ২টি:
- ১. দাওয়াতের মাধ্যমে জীবনে ঈমান বিরোধী ভুলত্রুটি থেকে পরিশুদ্ধ করার অবকাশ পায়।
- ২. দাওয়াতের ফলে নিজের মধ্যে অনেক গুণ বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি হয়।
- জ. যে সব দিক হতে বিপদ/সমস্যা আসতে পারে:
- ১. প্রথমে হতাশা ব্যঞ্জক অবস্থার সৃষ্টি হয়।
- ২. অপমানকর উক্তি ও ভর্ৎসনা করা।
- ৩. মূর্খতামূলক কার্য দ্বারা অসম্মান করা।
- ৪. নানা প্রকার অভিযোগ ও দোষারোপ করা।
- ৫. ফেতনায় জড়ানোর উপায় অবলম্বন করা।
- ৬. ঘর হতে বিতাড়িত করা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা।
- ৭. তার জীবন দুর্বিষহ করা।
- ঝ. এ সব বিপদ-মুসিবতে কর্মীর মধ্যে যে গুণ-বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধিত হয়:
- ১. সাহস হারা হয়ে সত্যের আন্দোলন থেকে বিরত থাকে না।
- ২. বাতিলের সামনে আত্মসমর্পণ করে না।
- ৩. বিক্ষুব্ধ হয়ে বিবেক-বুদ্ধি হারায় না।
- ৪. বৈজ্ঞানিক কর্মপন্থা, বুদ্ধিমত্তা, নমনীয় দৃঢ়তা, স্থিরতা, সততা, পরহেজগারীর অধিকারী হওয়া।
- ৫. একনিষ্ঠ মন নিয়ে নিজ আদর্শের উপর অটল অবিচল থাকে।
- ৬. পরিবেশকে অনুকূল করার অবিশ্রান্ত চেষ্টা চালায়।
- ঞ. আদর্শ প্রচারে কুরআনে উপস্থাপিত কর্মীর কর্মনীতি:
- ১. উত্তম উপদেশের মাধ্যমে দাওয়াত উপস্থাপন করা।
- ২. স্বাভাবিক পদ্ধতিতে দ্বীনের মূলনীতির ভিত্তিতে বাস্তব জীবনের দাওয়াত পেশ করা।
- ৩. সাধ্যাতীত খোরাক দান না করা।
- ৪. খুঁটিনাটি বিষয় পেশ না করা ও অবৈজ্ঞানিক কাজ করতে নিষেধ করা।
- ৫. মৌলিক দোষ-ত্রুটি দূর করার আগে বাহ্যিক দোষ-ত্রুটি দূর করার চেষ্টা করা।
- ৬. অবজ্ঞা মিশ্রিত ব্যবহার না করা।
- ৭. মন্দের বিপরীতে উত্তম ব্যবহার।
- ৮. অত্যাচার ও নিপীড়নের ফলে ধৈর্য ধারণ করা।
- ৯. অর্থহীন কথাবার্তা উপেক্ষা করা।
- ট. যে কর্মনীতির আলোকে লোকদেরকে আন্দোলনে টানা যায়:
- ১. রিয়া ও প্রদর্শনমূলক কাজ হতে বিরত থাকা।
- ২. নিজেদের কীর্তি-কলাপ গৌরবের সহিত লোকদের সামনে পেশ না করা।
- ৩. সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা ও তার কাছে ফলাফল আশা করা।
- ৪. মনের মধ্যে সর্বদা আল্লাহর ভয় থাকা।
- ৫. তড়িৎ ফলাফল না আসলে কৃত্রিম ও প্রদর্শনমূলক কর্মনীতি গ্রহণ না করা।
- ঠ. আমাদের রাজনৈতিক কর্মনীতি:
- ১. বাতিল শাসন ব্যবস্থার আইন-আদালতের সাহায্য গ্রহণ করবো না।
- ২. জান-মাল ও ইজ্জত-সম্মান রক্ষার জন্য বাতিল রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাহায্য গ্রহণ করবো না।
- ৩. যারা এই সীমা লঙ্ঘন করবে তাদের জামায়াতের মধ্যে থাকতে দেওয়া হবে না।
- ৪. যারা স্বার্থের-আত্মীয়তা রক্ষার জন্য মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়ে জামায়াতে তার স্থান নেই।
- ড. আমাদের কর্মনীতির যৌক্তিকতা ও সার্থকতা ৪টি:
- ১. প্রথমত: আমরা একটি আদর্শবাদী জামায়াত কিনা তা প্রমাণ করা যায়।
- ২. দ্বিতীয়ত: সদস্যদের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার সন্দেহাতীত মানদন্ড।
- ৩. তৃতীয়ত: সদস্যরা আইনের পরিবর্তে নীতি-নৈতিকতার ভিত্তিতে সমাজের সাথে সম্পর্ক করবে।
- ৪. চতুর্থত: সমাজে নৈতিক ও বাস্তব অবস্থা উলঙ্গ করে দেখা সম্ভব হয়। ধর্মের আবরণে লুকায়িতদের চরিত্র ফুটে উঠবে।
- আমাদের কর্মনীতিকে যাচাই করার আহবান:
- ১. আমাদের কর্মনীতি কী ধরনের,
- ২. মানুষকে কোন দিকে ডাকছি এবং সেই দাওয়াত কতখানি সত্য,
- ৩. কুরআন ও হাদিসের সাথে সামঞ্জস্য আছে কি না,
- ৪. বর্তমান সমাজের রোগ প্রতিষেধক হিসাবে বাতিল মতবাদ নির্মূল করার মতো কি না।
আলেম ও পীর সাহেবদের দোহাই
- ক. আলেম ও পীর সাহেবদের প্রতি প্রশ্ন/জিজ্ঞাসা:
- ১. বড় আলিম ও পীর সাহেবরা কি দ্বীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ওয়াকিফহাল নহেন?
- ২. জামায়াত ইসলামীর যে রূপ প্রচার করে থাকে, তারা কি তা বুঝতে পারে নাই?
- ৩. তাদেরকে বার বার বলা সত্ত্বেও তারা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত নহে-তার কারণ কী?
- ১. আমি (মওদুদী) দ্বীন-ইসলামকে বর্তমান ও অতীত ব্যক্তিদের থেকে বুঝতে চেষ্টা করি নাই।
- ২. ইসলামকে কুরআন ও রাসুলের সুন্নাহ থেকে বুঝার চেষ্টা করেছি।
- ৩. দ্বীন আমার ও ঈমানদারের নিকট কী দাবী করে, তা জানার জন্য কোনো বুজুর্গ ব্যক্তি কী করেন/বলেন-সে দিকে ভ্রুক্ষেপ করি নাই।
- ৪. বরং আমি এক্ষেত্রে কুরআন ও নবী-রাসুলের কর্মনীতি বুঝার চেষ্টা করেছি।
- গ. আলিম ও পীর সাহেবদের প্রতি আমার আহবান:
- ১. গৃহীত কর্মনীতি কুরআনের নির্দেশ ও নবীদের কার্যকলাপ হতে প্রমাণিত হয় কিনা, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তা বিচার করুন।
- ২. আপনারা কুরআন ও সুন্নাহ হতে জ্ঞান লাভ করতে প্রস্তুত থাকুন।
- ৩. আপনারা আমার দাওয়াত গ্রহণ করে আমার সাথে মিলিত হোন।
- ৪. আমাদের দাওয়াতে কুরআন-সুন্নাহর বিপরীত কিছু থাকলে তা প্রমাণিত করুন।
- ৫. কুরআন-সুন্নাহ হতে সরে গেছি প্রমাণিত হলে সত্য গ্রহণে মুহূর্ত বিলম্ব করব না।
- ৬. কিন্তু হক ও বাতিলের প্রমাণ করার জন্য যদি কুরআন-সুন্নাহ ব্যতীত ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করেন, তা আপনাদের ইচ্ছাধীন।
দরবেশীয় বিদ্রুপ
- ১. জামায়াতে ইসলামী কতগুলো দরবেশ ও দুনিয়া ত্যাগী লোকদের দল।
- ২. পৃথিবীর বাস্তবতা ও রাজনীতি থেকে তারা অনেক দূরে।
- ৩. মুসলমানদের বর্তমান সংকটপূর্ণ সময়ে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা তাদের নাই।
- ৪. যাদের বাস্তব জীবনের সমস্যার দিকে নজর বেশি, তারা এ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে না।
- খ. তাদের প্রতি উত্তর হলো:
- বর্তমান রাজনীতিবিদরা স্থূলদৃষ্টি নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
- তারা শুধু রাজনৈতিক সমস্যা ও বাহ্যিক রদ-বদলকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।
- কিন্তু রাজনীতির প্রাসাদ যে ভিত্তির উপর স্থাপিত, তাতে তাদের দৃষ্টি এখনো পৌঁছায় নাই।
- গ. বর্তমান (ভারতের) রাজনৈতিক সমস্যা জটিল আকার ধারণ করার কারণ হচ্ছে:
- ১. সমাজের নৈতিক চরিত্র, বিশ্বাস, তাহযীব যে ভিত্তির উপর স্থাপিত ছিল তা দুর্বল হয়ে পড়ে। পথভ্রষ্ট ইংরেজ ১টি জাতি (ইংরেজরা) সহস্র মাইল দূর থেকে এসে দেশকে পরাভূত করে।
- ২. মুসলমানদের এই পরাধীনতা ও দুর্বলতার সুযোগে তাদের প্রতিবেশী জাতি শক্তিশালী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা আরম্ভ করে। তাই ঘরের শত্রুও বাইরের শত্রুকে মোকাবেলা করা জটিল হয়ে পড়ে।
- ঘ. বর্তমান বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের কারণ:
- ১. নিজেদের নৈতিকতা, তাহযীব, অর্থনীতি, রাজনীতির ভিত্তি রেখেছে খোদাদ্রোহী শক্তির উপর।
- ২. ফাসেকী ও কুফুরী ব্যবস্থার বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
- ৩. আমার (মওদুদী) দৃষ্টিতে-মূলত ইসলামের দৃষ্টিতে এই রাজনীতি একেবারেই অর্থহীন।
- ঙ. বর্তমান বিশ্ব মুসলিমের সমস্যা-জটিলতার সমাধান হচ্ছে:
- ১. আল্লাহর বিধানকে নিজেদের জীবন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করা।
- ২. পৃথিবীর কর্তৃত্ব খোদাদ্রোহী, কাফির, ফাসিকদের থেকে নেকবান্দাদের হাতে তুলে দেওয়া।
- ৩. সকলে মিলে খোদার দাসত্ব করা।
- চ. আমরা কী রকম দল গঠন করতে চাই:
- ১. যারা তাকওয়ার দিক থেকে সমাজের সাধারণ পরহেজগারদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর হবে।
- ২. বিশ্ব পরিচালনার যোগ্যতা-দক্ষতার দিক দিয়ে বর্তমান লোকদের থেকে বেশি অগ্রসর হবে।
- ছ. বর্তমানে পরহেজগারী মনে করা হয়:
- ঘরের কোণায় বসে বাস্তব জগতের কাজ-কর্মের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করাকে।
- জ. বিপর্যয় সংশোধনের উপায় হচ্ছে:
- ১. খোদার নেক বান্দাদের একটি সুসংবদ্ধ জামায়াত গঠন।
- ২. দলের প্রত্যেকটি লোক খোদাভীরু, ন্যায়পন্থী ও বিশ্বাস ভাজন হবে।
- ৩. খোদার মনোনীত চরিত্র ও গুণাবলীতে ভূষিত হবে।
- ৪. সেই সঙ্গে দুনিয়ার লোকদের পরাজিত করার মতো বিশ্ব পরিচালনার যোগ্যতাও সর্বাধিক হবে। আমাদের দৃষ্টিতে ইহা অপেক্ষা বড় রাজনীতি আর হতে পারে না।
জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের প্রতি মাওলানা মওদুদীর উপদেশ
- ১. জেনে বুঝে আল্লাহর নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে দায়িত্ব নিয়েছেন, তা গভীরভাবে উপলব্ধি করুন এবং এই গুরু দায়িত্ব পালন করুন।
- ২. দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অনুধাবন করে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে চলুন।
- ৩. অনেক কর্মীরা আদর্শ, উদ্দেশ্য ও মতবাদ বুঝেছে, কিন্তু কর্মনীতি আদৌ বুঝে নাই। তাই কর্মনীতিও ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করুন।
- ৪. স্থূলদর্শিতা, প্রদর্শনমূলক মনোবৃত্তি এবং দ্রুত ফলাফল পাওয়ার মানসিকতা পরিহার করুন।
- ৫. দাওয়াত ও প্রচারণার ক্ষেত্রে নির্মমতা ও কঠোরতা পরিহার করে সহজ ও সরলভাবে যুক্তির মাধ্যমে দাওয়াত উপস্থাপন করুন।
Top
ইমানি পরীক্ষা সংক্রান্ত
আয়াত মুখস্ত আল বাকারা: ২১৪
اَمۡ حَسِبۡتُمۡ اَنۡ تَدۡخُلُوا الۡجَنَّۃَ وَ لَمَّا یَاۡتِكُمۡ مَّثَلُ الَّذِیۡنَ خَلَوۡا مِنۡ قَبۡلِكُمۡ ؕ مَسَّتۡهُمُ الۡبَاۡسَآءُ وَ الضَّرَّآءُ وَ زُلۡزِلُوۡا حَتّٰی یَقُوۡلَ الرَّسُوۡلُ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَهٗ مَتٰی نَصۡرُ اللّٰهِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ نَصۡرَ اللّٰهِ قَرِیۡبٌ ﴿۲۱۴﴾
তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা বেহেশত প্রবেশ করবে; যদিও পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের অবস্থা এখনো তোমরা প্রাপ্ত হওনি? দুঃখ-দারিদ্র্য ও রোগ-বালা তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত-কম্পিত হয়েছিল। তারা এতদূর বিচলিত হয়েছিল যে, রসূল ও তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারিগণ বলে উঠেছিল, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।
সূরা আনকাবুত: ১-৩
الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾ اَحَسِبَ النَّاسُ اَنۡ یُّتۡرَكُوۡۤا اَنۡ یَّقُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا وَ هُمۡ لَا یُفۡتَنُوۡنَ ﴿۲﴾ وَ لَقَدۡ فَتَنَّا الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ فَلَیَعۡلَمَنَّ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا وَ لَیَعۡلَمَنَّ الۡكٰذِبِیۡنَ ﴿۳﴾
(১) আলিফ-লাম-মীম; (২) মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা বিশ্বাস করি’ এ কথা বললেই ওদেরকে পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেওয়া হবে? (৩) আমি অবশ্যই এদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম; সুতরাং আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী।
ইমানি পরীক্ষা সংক্রান্ত ১টি হাদীস মুখস্ত
وقال :” إن الصالحين يشدد عليهم، وإنه لا يصيب مؤمناً نكبة من شوكة فما فوق ذلك، إلا حُطت بها عنه خطيئة، ورفع بها درجة “
তিনি আরও বলেন; “নিশ্চয়ই **নেককারদের উপর কঠিন বিপদ দেওয়া হয়**। আর মুমিন বান্দার উপর কাঁটা বা তার চেয়ে নগণ্য পরিমাণ মত বিপদ আসে, তার প্রতিটির জন্য তার গুনাহ ক্ষমা করা হয় এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়।”
(তাবারানি, সিলসিলাতুস সাহিহা ১৬১০)
وقال :”إن عظم الجزاء مع عظم البلاء، وإن الله إذا أحب قوماً ابتلاهم، فمن رضي فله الرضى ومن سخط فله السخط“
তিনি আরও বলেন; নিশ্চয়ই **বড় প্রতিদান বড় পরীক্ষার সাথেই**। আল্লাহ যখন কোন সম্প্রদায়কে ভালবাসেন, তখন তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন। অতঃপর যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর যে তাতে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য থাকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।
(তিরমিজি, ইবনে মাযাহ, সিলসিলাতুস সাহিহা ১৪৬)
Top
মাসয়ালা: হাজ্ব- হজ্বের সংক্ষিপ্ত নিয়ম ও জরুরি মাসায়িল
মাওলানা মুহম্মাদ ইয়াহইয়া
হজ্ব তিন প্রকার
-
তামাত্তু হজ্ব
মীকাত অতিক্রমের পূর্বে শুধু উমরার নিয়তে ইহরাম বেঁধে মক্কা মুকাররামায় পৌঁছে উমরার কাজ সম্পাদন করে চুল কেটে ইহরামমুক্ত হয়ে যাওয়া। অতঃপর এই সফরেই ৮ যিলহজ্ব হজ্বের ইহরাম বেঁধে হজ্বকার্য সম্পাদন করা। (দমে শুকর ওয়াজিব)
-
ইফরাদ হজ্ব
মীকাত অতিক্রমের পূর্বে শুধু হজ্বের নিয়তে ইহরাম বেঁধে মক্কা মুকাররামা পৌঁছে (উমরা না করা বরং তাওয়াফে কুদুম করে মুস্তাহাব তাওয়াফ করা) ইহরাম অবস্থায় হজ্বের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা। (দমে শুকর ওয়াজিব নয়)
-
কিরান হজ্ব
মীকাত অতিক্রমের পূর্বে একই সাথে উমরা ও হজ্বের নিয়তে ইহরাম বেঁধে এই ইহরামে উমরাহ ও হজ্ব উভয়টি পালন করা। মক্কা মুকাররামা পৌঁছে প্রথমে উমরা করা অতঃপর এই ইহরাম অবস্থাতেই হজ্বের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা এবং হজ্বের সময়ে হজ্ব করা। (দমে শুকর ওয়াজিব)
ইহরাম বাঁধার নিয়ম
হজ্ব অথবা উমরার নিয়তে **তালবিয়া পড়লেই** ইহরাম সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে এর সুন্নাত তরীকা হল:
জরুরি মাসায়েল (ইহরাম)
মাসআলা: তালবিয়া পূর্ণ পড়তে হবে। এর অল্প কিছু ছেড়ে দেওয়াও মাকরূহ।
মাসআলা: তালবিয়ার স্থলে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, বা আল্লাহ তাআলার কোনো জিকির পড়লেও ইহরাম সম্পন্ন হবে, কিন্তু তালবিয়া পড়াই উত্তম।
মাসআলা: মহিলাগণ ওযর অবস্থায় (মাসিক, প্রসবোত্তর স্রাব) থাকলেও ইহরাম বাঁধতে ও তালবিয়া পড়তে পারবে। তবে এ অবস্থায় তাওয়াফ করা, নামায পড়া জায়েয নয়।
মাসআলা: ইহরাম অবস্থায়ও মহিলাদের জন্য **পরপুরুষের সামনে চেহারা খোলা নিষিদ্ধ**। তাই কাপড়ের স্পর্শ এড়িয়ে চেহারার পর্দা করা জরুরি।
ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়
- পুরুষের জন্য শরীরের কোনো অঙ্গের আকৃতি অনুযায়ী তৈরিকৃত বা সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করা নিষিদ্ধ। (যেমন: পাঞ্জাবি, শার্ট, প্যান্ট ইত্যাদি)।
মাসআলা: ইহরামের কাপড় ছিঁড়ে গেলে তা সেলাই করে বা জোড়া দিয়ে পরা যাবে। সেলাইযুক্ত ব্যাগ ও বেল্ট বাঁধা নিষিদ্ধ নয়।
- পুরুষের জন্য মাথা ও চেহারা ঢাকা নিষিদ্ধ। মহিলাদের জন্য চেহারায় কাপড় স্পর্শ করানো নিষেধ।
- পুরুষের জন্য পায়ের উপরের অংশের উঁচু হাড় ঢেকে যায় এমন জুতা পরিধান করা নিষেধ।
- ইহরামের কাপড় বা শরীরে আতর বা সুগন্ধি লাগানো নিষেধ। সুগন্ধি সাবান, পাউডার, ক্রীম, সুগন্ধিযুক্ত তেল ব্যবহার করা যাবে না।
- শরীরের কোনো স্থানের চুল, পশম বা নখ কাটা বা উপড়ানো নিষিদ্ধ।
- স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করা বা এ সংক্রান্ত কোনো কথা বা কাজ করা নিষিদ্ধ। (আরাফায় অবস্থানের পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হলে হজ্ব নষ্ট হয়ে যায়)।
- কোনো বন্য পশু শিকার করা বা কোনো শিকারীকে সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ।
- ঝগড়া-বিবাদ করা।
- কাপড় বা শরীরের উকুন মারা নিষিদ্ধ।
মাসআলা: ইহরাম অবস্থায় মাথা ও মুখ ব্যতীত পূর্ণ শরীর চাদর ইত্যাদি দিয়ে আবৃত করা যাবে। কান, ঘাড়, পা ঢাকা যাবে।
উমরার পদ্ধতি
উমরার ফরয দুটি:
- ১। উমরার ইহরাম বাঁধা।
- ২। বাইতুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করা।
উমরার ওয়াজিব দুটি:
- ১। সাফা-মারওয়ার মাঝে সায়ী করা।
- ২। মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছাঁটা।
তাওয়াফের জরুরি মাসায়েল
- যে তাওয়াফের পর সায়ী আছে, সেই তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে **রমল** (বীরদর্পে কাঁধ হেলিয়ে দ্রুত বেগে চলা) এবং পুরো তাওয়াফে **ইজতিবা** (ডান কাঁধ খালি রাখা) করা শুধু পুরুষদের জন্য সুন্নতে মুআক্কাদাহ।
- তাওয়াফকারীর সীনা বাইতুল্লাহ দিকে করে তাওয়াফ করা যাবে না।
- সকল তাওয়াফের পর দুই রাকাত নফল নামায পড়া ওয়াজিব। এটি মাকামে ইব্রাহীমীর পিছনে পড়া ভালো।
হজ্বের পদ্ধতি
হজ্বের ফরয তিনটি:
- ইহরাম বাঁধা।
- উকূফে আরাফা: ৯ যিলহজ্ব সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে সুবহে সাদিকের পূর্বে স্বল্প সময়ের জন্য আরাফার ময়দানে অবস্থান করা।
- তাওয়াফে যিয়ারত: ১০ যিলহজ্ব থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগে সম্পন্ন করা।
হজ্বের ওয়াজিবসমূহ:
- উকূফে মুযদালিফা (১০ যিলহজ্ব সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত)।
- সাফা-মারওয়ার মাঝে সায়ী করা।
- নির্দিষ্ট দিনগুলোতে জামরাতে রমী তথা কংকর নিক্ষেপ করা।
- তামাত্তু ও কিরান হজ্ব আদায়কারীর জন্য **দমে শুকর** (হজ্বের কুরবানী)।
- মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছাঁটা।
- মীকাতের বাহির থেকে আগত লোকদের জন্য **তাওয়াফে বিদা**।
প্রথম দিন: ৮ যিলহজ্ব (মিনা গমন)
- আজ সূর্যোদয়ের পর ইহরাম অবস্থায় মিনায় গমন করতে হবে।
- যোহর থেকে পরবর্তী দিনের ফজর পর্যন্ত মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামায মিনায় পড়া এবং রাত্রি মিনায় অবস্থান করা সুন্নত।
- তামাত্তু হজ্বকারী আজ মিনায় যাওয়ার পূর্বে হজ্বের ইহরাম বাঁধবে।
মাসআলা: হজ্বের ইহরামের পর থেকে ১০ তারিখ জামরা আকাবায় কংকর নিক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত **তালবিয়া** পড়তে থাকবে।
দ্বিতীয় দিন: ৯ যিলহজ্ব (উকূফে আরাফা)
আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা
- ৯ তারিখ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়া উত্তম।
- আরাফায় পৌঁছলে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ওয়াজিব।
উকূফে আরাফার করণীয়
- উত্তম হল, কিবলামুখী হয়ে **দাঁড়িয়ে একেবারে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুআ করা**।
মাসআলা: কেউ যদি সূর্যাস্তের আগে আরাফা থেকে বেরিয়ে যায়, তবে পুনরায় আরাফায় ফিরে যাওয়া কর্তব্য। ফিরে না গেলে দম দিতে হবে।
মাসআলা: আরাফার ময়দানে মুকীম হাজীগণ যোহর-আসর **পূর্ণ চার রাকাতই পড়বেন**, কসর করবেন না।
মাসআলা: মসজিদে নামিরার জামাতে অংশগ্রহণ করতে পারলে যোহর ও আসর একত্রে ইমামের পিছনে আদায় করবে। সম্ভব না হলে নিজ নিজ ওয়াক্তে পড়বে।
মুযদালিফায় রওয়ানা
- আরাফার ময়দান থেকে **সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামায না পড়েই** মুযদালিফার উদ্দেশে রওয়ানা হবে।
- মাগরিব ও ইশা ইশার ওয়াক্তে মুযদালিফায় গিয়ে একত্রে পড়তে হবে (এক আযান ও এক ইকামতে উত্তম)।
৩য় দিন: ১০ যিলহজ্ব (রমী, কুরবানী ও চুল কাটা)
উকূফে মুযদালিফা (ওয়াজিব)
জামরায়ে আকাবার রমী (ওয়াজিব)
- মসজিদে হারামের দিক থেকে সর্বশেষ স্থানকে জামরা আকাবা বলা হয়। এখানে **৭টি কংকর** নিক্ষেপ করতে হয়।
- সময়: ১০ম যিলহজ্ব সূর্যোদয়ের পর থেকে দিবাগত রাতের সুবহে সাদিক পর্যন্ত।
- প্রথম দিনের সাতটি কংকর মুযদালিফা থেকে সংগ্রহ করা মুস্তাহাব।
- কংকর: বুট বা ছোলার দানার মত ছোট হওয়া ভালো।
- জামরা আকাবার রমীর পর দুআর জন্য অবস্থান করা সুন্নত নয়।
মাসআলা: ভীড়ের কারণে শরয়ী ওযর থাকলে অন্যকে দিয়ে রমী করানো যাবে, তবে তার অনুমতি লাগবে।
দমে শুকর বা হজ্বের কুরবানী (তামাত্তু ও কিরানকারীর জন্য ওয়াজিব)
- সময়: ১০ যিলহজ্ব সুবহে সাদিকের পর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত। (সুন্নত: ১০ যিলহজ্ব সূর্যোদয়ের পর)।
- স্থান: **হেরেমের সীমার ভিতরে** করা জরুরি।
- কুরবানীর গোশত হাজী নিজেও খেতে পারবে।
মাসআলা: কুরবানীর সামর্থ না থাকলে ৩টি রোযা আরাফার দিন পর্যন্ত শেষ করতে হবে এবং বাকী ৭টি পরবর্তীতে রাখতে হবে।
মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা (ওয়াজিব)
- সময়: কুরবানীর পর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত।
- পরিমাণ: চুল না মুণ্ডিয়ে খাটো করলে **আঙুলের এক কর (প্রায় এক ইঞ্চি)** পরিমাণ ছোট করা ওয়াজিব।
মাসআলা: মাথা মুণ্ডানোর আগে নখ বা শরীরের অতিরিক্ত পশম কাটা যাবে না, কাটলে জরিমানা দিতে হবে।
তাওয়াফে যিয়ারত (ফরয)
- সময়: ১০ যিলহজ্ব সুবহে সাদিক থেকে **১২ যিলহজ্বের সূর্যাস্তের আগে**।
- ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পর করলে দম দেওয়া জরুরি।
- তাওয়াফে যিয়ারত অসুস্থ হলেও **নিজেকেই** করতে হবে (হুইল চেয়ার ব্যবহার করা যাবে)।
মাসআলা (ঋতুমতি মহিলা): স্রাব চলাকালীন তাওয়াফ নিষিদ্ধ। যদি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পরও পবিত্র না হন, তবে পবিত্র হওয়ামাত্র আদায় করে নিবেন।
মাসআলা (দেশে ফেরার তাড়া): ১২ তারিখের মধ্যে পবিত্র না হলে, ফিরার তারিখ হয়ে গেলে অপারগতার কারণে অপবিত্র অবস্থায় তাওয়াফ করে নিবে এবং **একটি উট বা গরু দম হিসাবে জবাই** করবে। তাওয়াফ না করে দেশে যাওয়া যাবে না।
৪র্থ দিন: ১১ যিলহজ্ব (রমী)
- ১১ ও ১২ যিলহজ্বের রাত্রিতে **মিনায় অবস্থান করা সুন্নত**।
- রমীর সময়: যোহরের সময় থেকে আগত রাত্রের সুবহে সাদিক পর্যন্ত।
- ১১ যিলহজ্ব **তিন জামরাতেই রমী** করতে হবে। প্রথম দুই জামরাতে কংকর নিক্ষেপ করে কিবলামুখী হয়ে দুআ করা সুন্নাত।
৫ম দিন: ১২ যিলহজ্ব (রমী ও মিনা ত্যাগ)
- রমীর সময়: যোহরের সময় থেকে রাতের সুবহে সাদিক পর্যন্ত।
- ১১ ও ১২ তারিখ **যোহরের পূর্বে রমীর সময় শুরুই হয় না**।
মাসআলা: কেউ যদি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে রমী করে মিনা ত্যাগ করতে না পারে, আর মিনায় **১৩ তারিখ সুবহে সাদিক হয়ে যায়** তবে ঐ দিন রমী করা **ওয়াজিব**। রমী না করে চলে গেলে দম ওয়াজিব হবে।
১৩ যিলহজ্ব (ঐচ্ছিক রমী)
- ১৩ তারিখ রমী করা উত্তম (নবী ﷺ চতুর্থ দিন রমী করেই মিনা ত্যাগ করেছিলেন)।
- ১৩ তারিখ যোহরের পূর্বের রমী জায়েয। যোহর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় হচ্ছে রমী করার সুন্নত ওয়াক্ত।
তাওয়াফে বিদা (বিদায়ী তাওয়াফ)
- মীকাতের বাইরে অবস্থানকারী হাজীদের জন্য মক্কা মুকাররামা ত্যাগ করার আগে একটি তাওয়াফ করা **ওয়াজিব**।
- মক্কা ও মীকাতের ভিতর অবস্থানকারীদের জন্য এটি ওয়াজিব নয়, মুস্তাহাব।
লক্ষণীয়: হজ্বের মৌলিক বিষয়গুলো এখানে উল্লেখ করা হলো। হজ্ব করতে গিয়ে ভুল-ভ্রান্তি বা অন্য কারণে কোনো মাসআলার সম্মুখীন হলে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেম থেকে তা জেনে নেওয়া আবশ্যক।
নামাজ সংক্রান্ত। Go