জ্বর হলো শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৬°F (৩৭°C) থেকে বেড়ে যাওয়া। এটি একটি উপসর্গ, রোগ নয়। শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিভিন্ন সংক্রমণে জ্বর দেখা দেয়।
জ্বরের সাধারণ প্রকারভেদ
Continuous Fever: সারাদিন তাপমাত্রা বেশি থাকে, সামান্য উঠানামা করে (উদা: টাইফয়েড)।
Remittent Fever: তাপমাত্রা দিনভর থাকে কিন্তু কিছুটা ওঠানামা করে (উদা: ভাইরাল ইনফেকশন)।
Intermittent Fever: মাঝে মাঝে জ্বর আসে, আবার কমে যায় (উদা: ম্যালেরিয়া)।
জ্বর (Fever) হলো শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপমাত্রা, যা সাধারণত কোনো অন্তর্নিহিত রোগের লক্ষণ। হোমিওপ্যাথিতে জ্বরের কারণ, প্রকৃতি এবং রোগীর সামগ্রিক লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ঔষধ নির্বাচন করা হয়। নিচে জ্বরের কিছু প্রধান প্রকারভেদ এবং এর জন্য প্রযোজ্য কিছু হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মূল বৈশিষ্ট্য (Key Points) আলোচনা করা হলো:
১. অবিরাম জ্বর (Continuous Fever)
এই ধরনের জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১° সেলসিয়াস বা ১.৫° ফারেনহাইট এর বেশি ওঠানামা করে না এবং সব সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ও তাদের মূল বৈশিষ্ট্য:
বেলেডোনা (Belladonna):
হঠাৎ করে জ্বর আসে এবং দ্রুত তাপমাত্রা বাড়ে।
মুখমণ্ডল লাল ও উত্তপ্ত থাকে, চোখ দুটো ঝলমলে দেখায়।
মাথাব্যথা তীব্র হয়, মনে হয় ফেটে যাবে।
ঠান্ডা লাগলে বা আলোতে অস্বস্তি হয়।
প্রচণ্ড পিপাসা থাকে না বা থাকলেও অল্প অল্প জল পান করে।
শিশুদের ক্ষেত্রে খিঁচুনি প্রবণতা দেখা যেতে পারে।
একোনাইট (Aconitum napellus):
হঠাৎ করে জ্বর আসে, সাধারণত ঠাণ্ডা লাগার পর বা ভয় পাওয়ার পর।
উচ্চ জ্বর, সাথে অস্থিরতা, ভয় এবং মৃত্যুভয়।
ত্বক শুষ্ক ও গরম।
প্রচণ্ড পিপাসা থাকে, ঠান্ডা জল পান করতে চায়।
রাতে লক্ষণগুলো বৃদ্ধি পায়।
ব্রায়োনিয়া (Bryonia alba):
ধীরে ধীরে জ্বর আসে এবং ধীরে ধীরে বাড়ে।
যেকোনো নড়াচড়ায় কষ্ট হয়, রোগী চুপচাপ শুয়ে থাকতে চায়।
প্রচণ্ড পিপাসা থাকে, অনেক বেশি পরিমাণে জল পান করে।
জিহ্বা শুষ্ক, ঠোঁট শুষ্ক ও ফাটা।
কোষ্ঠকাঠিন্য থাকতে পারে।
২. সবিরাম জ্বর (Intermittent Fever)
এই জ্বরে নির্দিষ্ট সময় পর পর জ্বর আসে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্থায়ী থাকে, তারপর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। সাধারণত ম্যালেরিয়া জ্বরে এই ধরণ দেখা যায়।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ও তাদের মূল বৈশিষ্ট্য:
চায়না (China officinalis):
নির্দিষ্ট সময় পর পর জ্বর আসে, সাথে কাঁপুনি ও ঘাম হয়।
প্রচুর ঘাম হয় এবং ঘামের পর দুর্বলতা অনুভব হয়।
পেটে গ্যাস, পেট ফাঁপা বা ডায়রিয়া থাকতে পারে।
রক্তশূন্যতা বা দুর্বলতা।
নেট্রাম মিউর (Natrum muriaticum):
সকাল ১০-১১টায় জ্বর আসে।
জ্বরের সময় প্রচণ্ড পিপাসা থাকে।
জ্বর কমার পর প্রচুর ঘাম হয়।
ঠান্ডা লাগলে বা সূর্যের তাপে লক্ষণ বাড়ে।
লবণ খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা থাকে।
আর্সেনিক অ্যালবাম (Arsenicum album):
জ্বর সাধারণত মধ্যরাতে বাড়ে (১-২টা)।
প্রচণ্ড অস্থিরতা এবং মৃত্যুভয়।
অল্প অল্প করে ঘন ঘন জল পান করে।
জ্বালাকর ব্যথা থাকে।
দুর্বলতা ও অবসাদ।
৩. রেমিটেন্ট জ্বর (Remittent Fever)
এই জ্বরে তাপমাত্রা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২° সেলসিয়াস বা ৩° ফারেনহাইট এর বেশি ওঠানামা করে, কিন্তু কখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না। যেমন – টাইফয়েড জ্বর।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ও তাদের মূল বৈশিষ্ট্য:
ব্যাপ্টিসিয়া (Baptisia tinctoria):
টাইফয়েড জ্বরের প্রথম দিকে কার্যকর।
রোগী বিভ্রান্ত থাকে, মনে হয় তার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
মুখ থেকে দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস বের হয়।
প্রচন্ড দুর্বলতা ও ঘুম ঘুম ভাব।
রাস টক্স (Rhus toxicodendron):
অস্থিরতা, রোগী এক স্থানে স্থির থাকতে পারে না।
বিশেষ করে বৃষ্টির পর বা ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় জ্বর আসে।
শারীরিক পরিশ্রমে বাড়ে, কিন্তু অল্প নড়াচড়ায় উপশম হয়।
জিহ্বা ত্রিকোণাকার লাল।
৪. সেপ্টিক জ্বর (Septic Fever)
এই জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা ওঠানামা করে এবং সাধারণত শরীরেই কোনো সংক্রমণের কারণে এই জ্বর আসে।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ও তাদের মূল বৈশিষ্ট্য:
পাইরোজেন (Pyrogen):
সেপসিস বা রক্ত বিষক্রিয়া জনিত জ্বর।
তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত ঘাম, নিঃসরণ এবং মলমূত্র।
অস্থিরতা, পালস দ্রুত ও দুর্বল।
৫. ডেঙ্গু জ্বর (Dengue Fever)
বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বর একটি সাধারণ সমস্যা। এটি একটি ভাইরাসঘটিত জ্বর যা মশার মাধ্যমে ছড়ায়।
শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা, বিশেষ করে পিঠে ও হাত-পায়ে।
প্রচণ্ড পিপাসা, ঠান্ডা জল পান করতে চায়।
বমি বমি ভাব বা বমি।
জেলসিমিয়াম (Gelsemium sempervirens):
দুর্বলতা, অবসাদ এবং ঘুম ঘুম ভাব।
শরীরে কাঁপুনি।
পিপাসাহীনতা।
মাথা ভারি মনে হয়, চোখ বন্ধ রাখতে চায়।
গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য:
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং প্রতিটি রোগীর স্বতন্ত্র লক্ষণ সমষ্টির ওপর ভিত্তি করে ঔষধ নির্বাচন করা হয়। উপরে উল্লিখিত ঔষধগুলো কেবল কিছু সাধারণ নির্দেশনা। যেকোনো জ্বরের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যদি জ্বর বেশি হয় বা দীর্ঘস্থায়ী হয়, একজন যোগ্যতাসম্পন্ন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য। নিজে নিজে ঔষধ সেবন করা থেকে বিরত থাকুন।
উপসংহার
হোমিওপ্যাথিতে রোগের বাহ্যিক নামের চেয়ে রোগীর উপসর্গ বেশি গুরুত্ব পায়। তাই রোগীর মানসিক ও শারীরিক লক্ষণ মিলিয়ে ঔষধ নির্বাচন করা প্রয়োজন। দীর্ঘস্থায়ী বা জটিল জ্বরের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।